Media School

Dhaka    Saturday, 20 April 2024

By নুসরাত জাহান

অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা...

Media School June 30, 2020

আমরা সমাজ তৈরি করেছি। আমাদের আছে নিজস্ব ধর্ম, সংস্কৃতি, ভাষা। আছে দেশ, দেশের সীমানা। কিন্তু এসব নিয়েও ভালো নেই আমরা। আমাদের এ সমাজে আছে ধনী-গরিব বৈষম্য। একই দেশের নাগরিক হয়েও আমরা লড়াই করি ধর্মের ভিন্নতা, গোত্র-বর্ণ নিয়ে; অন্য দেশের সঙ্গে সীমানা, নদীর পানি, জল ও স্থলপথ নিয়েও।

প্রকৃতিও রেহাই পায় না আমাদের লালসা থেকে। আমরা নিজ স্বার্থে ভরাট করি একের পর এক নদী। নির্বিচার প্রাণী হত্যা, গাছপালা-পাহাড় কেটে ধ্বংস আর সমুদ্রের পানি করি দূষিত। সুউচ্চ দালানের ভিড়ে আকাশ দেখি না এখন আমরা। জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে এসির বাতাসে আরাম করি আর প্রকৃতিকে করি মাত্রাতিরিক্ত উষ্ণ। আমাদের তৈরি কলকারখানা, পারমাণবিক চুল্লি, ইটভাটা, যানবাহনের বিষাক্ত ধোঁয়া, শব্দ আর বায়ুদূষণে প্রকৃতি আজ অতিষ্ঠ।

এভাবে নিজ স্বার্থ হাসিলে সর্বোচ্চ (বলা ভালো, সর্বনিম্ন) স্তরের জালিয়াতির মাধ্যমে জয়ী হওয়ার বিকৃত তাড়নার উন্মত্ততায় কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিন। এমন সময় বিশ্বের সব হিসাব পাল্টে দিল একটিমাত্র ভাইরাস। নভেল করোনা নামের ভয়াবহ রকমের ছোঁয়াচে এ ভাইরাসের আক্রমণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ রোগে থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। থেমে গেছে সব যুদ্ধ, বিরোধ, দলাদলি। দেশে দেশে গঠিত হচ্ছে তহবিল, বিরোধ ভুলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে এক দেশ আরেক দেশের প্রতি। এখনো কোনো ওষুধ বা টিকা আবিষ্কৃত না হওয়ায় এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার এখন পর্যন্ত একমাত্র উপায় ‘স্বেচ্ছা গৃহবন্দিত্ব’ যেন স্বার্থান্বেষী এ মানবজাতির প্রতি প্রকৃতির নির্মম উপহাস! মানুষের পদচারণ স্তব্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে প্রকৃতি মাতা, স্বরূপে আবির্ভূত হয়ে অকৃতজ্ঞ এ মানবজাতিকে জানিয়ে দিচ্ছে তার শক্তি আর সামর্থ্যের অসীমতা।

এ লেখাটি যখন লিখছি, আমার সাড়ে ছয় বছরের ছেলে পাশ থেকে হঠাৎ বলে উঠল, ‘মা, এভাবে আর কিছুদিন ঘরে আটকে থাকলে আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে!’ প্রায় এক মাস ঘরে বন্দী থাকায় ‘কাঁচা ছেলের পাকা কথা’ ভেবে এতে মজা পাওয়ার বদলে বরং শঙ্কিত হয়ে পড়ছি। তারপরও জীবন চালিয়ে নিতে হয়। তাই ‘অচেনা’ এ পরিস্থিতিকে সহজ করতে পড়াশোনার পাশাপাশি তার সঙ্গে বিভিন্ন খেলায় মেতে ওঠা, বারান্দায় লাগানো গাছের পরিচর্যা বা সবাই একসঙ্গে বসে তার পছন্দের সিনেমা দেখার মধ্য দিয়ে তাকে আনন্দে রাখার চেষ্টা করছি আমরা।

জানি না, বিশ্ব এ দুর্যোগ থেকে কবে পরিত্রাণ পাবে। নিষেধ অমান্য করে বিনা কারণে রাস্তায় মানুষের উপস্থিতি, ত্রাণের সামগ্রী লোপাট করা, কলকারখানা-মালিকদের শ্রমিকের জীবনের দাম না দেওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা পৃথিবীর অন্তিম সময় ডেকে নিয়ে আসবে বলে আশঙ্কা হয়।

কিন্তু খারাপ চিন্তা করতে চাই না। বরং আক্রান্ত হওয়ার নিশ্চিত আশঙ্কা জেনেও দেশে দেশে যেসব চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, সংবাদকর্মীসহ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, পুলিশ ও সেনাসদস্য এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন এবং যাঁরা অনাহারিদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন, তাঁরা মনে আশার সঞ্চার করেন। করোনাভাইরাসসৃষ্ট এ পরিস্থিতির শিক্ষা হয়তো আমাদের সত্যিকার অর্থেই উদার ও মানবিক হতে সাহায্য করবে। সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে পৃথিবী, প্রাণ ফিরে পাবে প্রকৃতি আর নিশ্চিন্ত মনে সন্তানকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে প্রতিটি মা-বাবা।

‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ সবার জন্য শুভকামনা।

* লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

[লেখাটি ৭ মে ২০২০ প্রথম আলো-তে প্রকাশিত হয়।]