Media School

Dhaka    Friday, 19 April 2024

By রাজীব সরকার

আরজ আলী মাতুব্বরের জিজ্ঞাসা

Media School May 24, 2021

আরজ আলী মাতুব্বর (১৭ ডিসেম্বর, ১৯০০ – ১৫ মার্চ ১৯৮৫)

সক্রেটিস বলেছিলেন, 'An unquestioned life is not worth living.' মানবসভ্যতার অগ্রগতির মূলে কাজ করেছে প্রশ্ন। প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক উত্তরের দীর্ঘ ইতিহাস মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়। অগণিত প্রতিভাবানকে এ জন্য কঠোর সাধনা ও ত্যাগ করতে হয়েছে, কেউ কেউ জীবন দান করেছেন। প্রায় শতবর্ষ আগে ঢাকা শহরের বুকে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মুখপত্র 'শিখা' পত্রিকার শীর্ষভাগে লেখা থাকত, 'জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।' কথাটির তাৎপর্য এ যুগে আরও প্রাসঙ্গিক। বুদ্ধির মুক্তির জন্য প্রশ্ন উত্থাপন এবং এর যৌক্তিক সমাধানের কোনো বিকল্প নেই। এদিক থেকে আমাদের সমাজে আপাত উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা দৃশ্যমান নয়। কেন এটি সম্ভব হলো না, এর উত্তর লুকিয়ে আছে আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনদর্শনে।

অতি ব্যবহার এবং অপব্যবহারে বাংলা ভাষার বহু শব্দ গুরুত্ব হারিয়েছে। এমন একটি শব্দ দার্শনিক। বাংলাদেশে দর্শনের ছাত্র বা শিক্ষকের অভাব নেই। দর্শনশাস্ত্রের অনুবাদকও রয়েছেন। তাদের মধ্যে খুব অল্পসংখ্যকই মৌলিক চিন্তা করেন। যারা মৌলিক চিন্তা করেন, তাদের অনেকেরই একাডেমিক ডিসিপ্লিন 'দর্শন' ছিল না। অথচ নির্বিচারে সবাইকে দার্শনিক অভিধায় ভূষিত করা হয়। আরজ আলী মাতুব্বর ছিলেন যথার্থই দার্শনিক। তিনি সেই নগণ্যসংখ্যক দার্শনিকের অন্যতম, যিনি মৌলিক চিন্তা করেছেন।

শুধু মৌলিক চিন্তা করেছেন বলে মাতুব্বর অবিস্মরণীয় নন। তার অসাধারণত্ব এখানে যে, তিনি উঠে এসেছেন তৃণমূলের গভীর স্তর থেকে। বাঙালির শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শনের নির্মাতা মধ্যবিত্ত শ্রেণি। আমাদের বুদ্ধিজীবীদেরও আবির্ভাব এই শ্রেণি থেকে। তাদের সৃষ্টিকর্মে নিম্নবিত্তের চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন না থাকাই স্বাভাবিক। তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলার নবজাগৃতি, বিংশ শতাব্দীতে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক জাগরণের অনস্বীকার্য ভূমিকা থাকার পরও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের বিচ্ছিন্নতা ঘুচল না। নাগরিক সংস্কৃতির আদলে বিকাশ ঘটল আধুনিক বাঙালি সংস্কৃতির। এই প্রেক্ষাপটে আরজ আলী মাতুব্বরের প্রাসঙ্গিকতাকে অনুধাবন করতে হবে। তিনি একাডেমিক শিক্ষা গ্রহণ করেননি, তিনি স্বশিক্ষিত। মধ্যবিত্ত সুবিধাভোগী শ্রেণি থেকে বহুদূরে তার আজীবন অধিষ্ঠান। দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তিনি সত্যের সন্ধান করেছেন। প্রতিকূলতাকে জয় করে তিনি সব কুপ্রথা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সাহসী অবস্থান গ্রহণ করেছেন।

কিন্তু সাহসই বড় কথা নয়। সাহস ডাকাতেরও থাকে। তার সাহসের উৎস পরিচ্ছন্ন চিন্তা ও যুক্তিবাদিতা। এর ধারাবাহিকতায় বস্তুবাদী চিন্তা ও ইহজাগতিকতা তার দর্শনকে পরিপকস্ফতা দান করে। শৈশবের একটি ঘটনা মাতুব্বরের জীবনদর্শন নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাতুব্বর লিখেছেন :

"১৩৩৯ সালে আমার মা মারা গেলে আমি আমার মৃত মায়ের ফটো তুলি। তা দেখে আমার মায়ের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধান করতে যেসব আলেম ও মুসল্লি এসেছিলেন, তারা আমার মায়ের জানাজা ও দাফন ত্যাগ করে লাশ ফেলে চলে যায়; যেহেতু ফটো তোলা নাকি হারাম। অগত্যা কতিপয় অমুসল্লিকে নিয়ে জানাজা ছাড়াই আমার মায়ের মৃতদেহটি সৃষ্টিকর্তার হাতে সোপর্দ করত হলো কবরে। আমার মা ছিলেন অতিশয় ধার্মিকা নারী। তার নামাজ-রোজা বাদ পড়া তো দূরের কথা, 'কাজা' হতেও দেখিনি কোনোদিন আমার জীবনে, বাদ পড়েনি কখনও তার তাহাজ্জুদের নামাজ মাঘ মাসের দারুণ শীতের রাতেও। এ হেন পুণ্যবতী মায়ের জানাজা হলো না আমার একটি দুস্কর্মের ফলে। হায় রে পবিত্র ধর্ম।"

এই অভিজ্ঞতা ধর্মীয় মূঢ়তার বিরুদ্ধে তাকে প্রতিবাদী হতে শেখায়। তাই নিজের মৃতদেহ সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে তাকে বেগ পেতে হয়নি। এ প্রসঙ্গে লিখেছেন :

'আমার ছেলেরা আমার মৃতদেহের ফটো তুলে রাখবারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমতাবস্থায় আমার মৃতদেহটি গোড়া মুসল্লিদের কাছে আনুষ্ঠানিক মর্যাদা না পাওয়াই সম্ভব। যদিও পায়, তবে আমার মায়ের মৃতদেহের অমর্যাদা ও আমার মরদেহের মর্যাদা দেখে তাতে আমার বিদেহী আত্মা তুষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাই আমি আমার মৃতদেহটিকে বিশ্ববাসীর অবহেলার বস্তু ও কবরে গলিত পদার্থে পরিণত না করে তা মানবকল্যাণে সোপর্দ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি।'

বিশ্বব্যাপী এক অসহিষ্ণুতার কাল অতিক্রম করছি আমরা। নিজের ধর্ম ও বিশ্বাস একমাত্র সত্য, অবশিষ্ট সব মিথ্যা- এমন অবৈজ্ঞানিক ধারণা থেকে অসহিষ্ণুতা ও উগ্রতার জন্ম হয়। বস্তুবাদ ও যুক্তিবাদিতার ওপর ভিত্তি করে আরজ আলী মাতুব্বর সত্যের সন্ধান করেছেন। তার অকাট্য প্রশ্ন :

'জগতে এমন অনেক বিষয় আছে, যেসব বিষয়ে দর্শন, বিজ্ঞান ও ধর্ম এককথা বলে না। আবার ধর্মজগতেও মতানৈক্যের অন্ত নাই। যেখানে একই কালে দুইটি মত সত্য হইতে পারে না, সেখানে শতাধিক ধর্মের প্রচলিত মত সত্য হইবে কীরূপে? যদি বলা হয় সত্য হইবে একটি তখন প্রশ্ন হইবে, কোনটি এবং কেন? অর্থাৎ সত্যতা বিচারের মাপকাঠি (criterion of truth) কী? সত্যতা প্রমাণের উপায় (test of truth) এবং সত্যের রূপ (nature of truth) কী?'

শুধু বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে মতান্তর নয়। মাতুব্বর লক্ষ করেছেন, একই ধর্মের মধ্যে বিপরীত মতবাদের উপস্থিতি। হিন্দু ধর্মের বেদ ও উপনিষদের অন্তঃসারের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। খ্রিষ্টধর্মে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। ইসলাম ধর্মের মধ্যে শিয়া, সুন্নি, মুতাজিলা, ওহাবি, খারিজি প্রভৃতি সম্প্রদায়ের মত ভিন্ন। এই উদাহরণগুলো উপস্থাপন করে মাতুব্বর লিখেছেন :

'এতোধিক মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও ভক্তদের নিকট আপন আপন ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম, অন্য কোনো ধর্মই সত্য নহে। এ যেন বাজারের গোয়ালাদের ন্যায় সকলই আপন আপন দধি মিষ্টি বলে।'

আরজ আলী মাতুব্বরের অন্যতম মূল্যবান বই 'সৃষ্টি রহস্য'। এ বইয়ে বিজ্ঞানীর মনোভাব সম্পর্কে তিনি যে যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা প্রকারান্তরে ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে শাণিত অস্ত্র হিসেবে কাজ করছে। তার ভাষায় :

'বিজ্ঞান হইল মানবজ্ঞানের পরিপকস্ফ অবস্থা এবং মানবসভ্যতার যৌবনাবস্থাও বটে। এই যুগে যুগমানবের আসনে সমাসীন বিজ্ঞানীরা, সমাজপতিরা নহেন। বিজ্ঞানীরা হইলেন নীরব সাধক। কোনো মতবাদ অটুট রাখিবার বা প্রতিষ্ঠা করিবার জন্য বিজ্ঞানীরা কখনও কোনোরূপ হৈচৈ করেন না। বিশেষত কোনো মতবাদকে সামান্য আঘাতে ভাঙিয়া যাওয়ার ভয়ে মুরগির ডিমের মতো পাখার নিচে গুঁজিয়া রাখে না, উহা ছড়িয়ে দেন বিশ্বের দরবারে- সত্যমিথ্যা যাচাইয়ের জন্য।'

সৃষ্টিতত্ত্বের ধর্মীয় ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে না মাতুব্বরের যুক্তিবাদী মন। বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দিলেন তিনি মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রার :

'দেখা যায়, সনাতন ধর্মীয় সৃষ্টিতত্ত্বে কোথায় ও কার্যকরণ সম্পর্কের ধারা বজায় নাই এবং জীবন যে জড় পদার্থ, ইহাদের কোন সৃষ্টির জন্য কোন উপাদানের উল্লেখ নাই, আছে শুধু ব্যবহার। ইহা যেন পূর্ব হইতে প্রস্তুত ছিল। সৃষ্টিতত্ত্বের ধর্মীয় ব্যাখ্যায় যুক্তির কোনো স্থান নাই। কার্যকারণ সম্পর্ক বজায় রাখিয়া যুক্তির সাহায্যে জগতের প্রত্যেকটি ঘটনা ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিল দর্শন। পরবর্তীকালে দর্শনশাস্ত্রে কার্যকারণ সম্পর্ক ও যুক্তিসমূহের ওপর ভিত্তি করিয়া প্রমাণসহ জাগতিক ঘটনা ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিল বিজ্ঞান।'

অকপট সত্য উচ্চারণের জন্য মাতুব্বরকে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার জীবন নিয়ে হাসনাত আবদুল হাই উপন্যাস লিখেছেন। সেখানে তাকে তুলনা করা হয়েছে গ্যালিলিওর সঙ্গে। তাদের দু'জনেই প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থা দ্বারা নিপীড়িত হয়েছিলেন। ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান বিষয়ে মাতুব্বরের স্পষ্ট বক্তব্য প্রতিক্রিয়াশীল ক্ষমতাবান গোষ্ঠীকে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। ফৌজদারি মামলায় তিনি গ্রেফতার হন। তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে পুলিশ সুপার অকারণ উপদেশ বর্ষণ করেন তার প্রতি :

'মানুষের প্রচলিত বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান, সংস্কারে আঘাত দিলে সামাজের স্থিতিশীলতা বজায় থাকে না। সুতরাং তুমি যত ইচ্ছা বই পড়ো, জ্ঞান অর্জন করো, ক্ষতি নেই। কিন্তু সেসব বিষয় নিয়ে কোনো আলোচনা করতে পারবে না। তুমি বইপত্র পড়ে যা জানবে, তা প্রচার করতে পারবে না- এই প্রতিশ্রুতি যদি দাও, তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি।'

নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রতিশ্রুতি দিয়ে মুক্ত হওয়ার আগে মাতুব্বর এসপিকে বলেছিলেন, 'ওই সব বইতেই পড়েছি সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, আপনি না চাইলেও সত্যের জয় হতো।' এই দৃঢ়চেতা উক্তি গ্যালিলিওকে স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতিক্রিয়াশীল চার্চ যখন তাকে 'আত্মসমর্পণ' করতে বাধ্য করেছে, তখন তিনি স্বগতোক্তি করেছেন যতই অস্বীকার করি, পৃথিবীই সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। অজ্ঞানতা ও কূপমণ্ডূকতাকে পরাজিত করেই গ্যালিলিওর বিশ্বাস বিশ্বজয়ী হয়েছে।

এভাবে কোপার্নিকাস, গ্যালিলিওর মতো বিশ্ববরেণ্য মনীষীদের উত্তরসূরি হয়ে ওঠেন আরজ আলী মাতুব্বর। প্রাকৃত জনসাধারণের ভেতর থেকে উঠে আসা মাতুব্বরের জীবনদর্শন কা জ্ঞান ও দৃঢ়তার সংমিশ্রণে পূর্ণতা লাভ করেছিল। লৌকিক সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করা সার্থক দার্শনিক তিনি। মুক্তচিন্তা, বিজ্ঞানমনস্কতা ও অসাধারণ পাি ত্য দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন ইহজাগতিকতার গুরুত্বকে। নিজের দেহকে মানবকল্যাণে দান করে গেছেন। নিজে প্রশ্ন করেছেন, অপরকে প্রশ্ন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মৃত্যুর পর কী, বেহেশত, দোজখ কোথায়- এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন তিনি। ইন্দ্রিয় তাড়না-জর্জরিত এই দেহই কি বেহেশতে ফিরে যাবে অফুরন্ত ইন্দ্রিয় তৃপ্তির জন্য? এক ইন্দ্রিয়পরায়ণ পৃথিবী থেকে ভোগ-লালসার জন্য অধিকতর ইন্দ্রিয়পরায়ণ জগতে প্রবেশই কি বেহেশত প্রাপ্তি? যুক্তিতর্ক দিয়ে এসব প্রশ্নের মীমাংসা করার চেষ্টা করেছেন। এতে তিনি কতটুকু সফল হয়েছেন, সে প্রশ্নে না গিয়েও বলা যায় একটি প্রচলিত, বদ্ধ সমাজ কাঠামোকে তিনি শক্ত হাতে নাড়া দিয়েছেন, মধ্যবিত্তের অহংবোধকে চূর্ণ করেছেন।

'চাচা কাহিনী' বইয়ে সৈয়দ মুজতবা আলী মন্তব্য করেছিলেন, 'ধর্মমাত্রই মোমবাতির আধা-আলোর কুসংস্কারে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতে পছন্দ করে, বিজলির কড়া আলোতে আত্মপ্রকাশ করতে চায় না।' কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিপরীতে আরজ আলী মাতুব্বরের জীবনদর্শন ছিল বিজলি তথা যুক্তির কড়া আলোর অনুগামী। একবিংশ শতাব্দীতে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতির যুগে যখন ধর্মীয় উগ্রতাও বিস্তার লাভ করেছে, তখন দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরকে স্মরণ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক সমকাল পত্রিকার কালের খেয়া-তে, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৮। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনরায় প্রকাশিত।