Media School

Dhaka    Thursday, 18 April 2024

By নাসরিন আক্তার

আলমগীর কবিরের ‘সূর্যকন্যা’: নারী নিপীড়নের জীবন্ত চিত্র

Media School July 10, 2020

দীর্ঘদিনের পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেহারা কেমন, কেমন করে এই ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে নারীদেরকে বিভিন্ন সামাজিক-পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দমিয়ে রাখছে, তাদেরকে নির্যাতন করে যাচ্ছে, দাসত্বের শিকলে বেঁধে রাখছে, এসবের জীবন্ত বর্ণনা রয়েছে সূর্যকন্যা সিনেমাতে। মূল চরিত্র লেনিনের স্বপ্নে বা কল্পনায় আসা এক নারী লাবণ্যের মাধ্যমে পুরুষতন্ত্রের তীব্র সমালোচনা করেছেন পরিচালক।

ড. নাদির জুনাইদ তার “প্রতিবাদের নান্দনিকতা: বাংলাদেশের প্রথাবিরোধী চলচ্চিত্র” বইয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে নির্মাণশৈলীর নতুনত্ব: আলমগীর কবিরের সূর্যকন্যা (১৯৭৬) আর রুপালি সৈকতে (১৯৭৯) নামক আর্টিকেলে এভাবে বলেছেন-‘পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের কর্তৃত্ব চর্চার মধ্যে যে অন্যায় টিকে আছে সূর্যকন্যা তার বিরুদ্ধেই হয়ে ওঠে একটি প্রতিবাদ’। এই প্রতিবাদ এসেছে হয় কল্পনা, ফ্যান্টাসি অথবা স্বপ্নের মাধ্যমে। তবে সুনির্দিষ্টভাবে তা স্বপ্ন নাকি ফ্যান্টাসি নাকি কল্পনা তা পরিচালক ছেড়ে দিয়েছেন দর্শকের একান্ত নিজস্ব উপলব্ধির উপর। পরিচালক এই প্রতিবাদ বাস্তবের কোনো নারীর মাধ্যমে তুলে না ধরে কেন এই স্বপ্ন/কল্পনা/ফ্যান্টাসি ব্যবহার করেছেন তার পিছনে ড. নাদির তার প্রবন্ধে যুক্তি দিয়েছেন এভাবে, ‘দীর্ঘদিন ধরে টিকে থাকা ব্যবস্থার সরাসরি সমালোচনা হয়তো সে সমাজে কঠিন যেখানে ক্ষমতাশালীরা পুরুষতান্ত্রিক কর্তৃত্বের সমালোচনা শুনতে অভ্যস্ত নয় (জুনাইদ, ২০১৭; পৃ. ৪৫-৪৬)। ড. নাদিরের মতে তাই সেন্সরের বাধা কাটাতে পরিচালক এখানে সুচিন্তিতভাবে ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়েছেন।

সিনেমার মূল চরিত্র লেনিন নামের এক যুবক যাকে ডাক্তার বানাতে চেয়েছিলেন বাবা। কিন্তু পড়েছেন নিজ ইচ্ছায় আর্টে, যিনি তার চিত্রকর্ম দিয়ে দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিতে চান, যাকে খেতে বসে বেকার হবার দায়ে বাবার কড়া কথা শুনতে হয়, যিনি বন্ধুর মাধ্যমে বন্ধুরই এক দোকানে চাকরি পান দোকান সজ্জার এবং সেখানেই এক ম্যানিকিনের সঙ্গে নিজের কল্পনা বা ফ্যান্টাসির মাধ্যমে ভালোবাসার সম্পর্কে জড়িয়ে তার কাছ থেকে নারীকে মুক্তির দায়িত্ব নেন। লেনিন শিল্পী হতে চায়। পুরো সিনেমা জুড়েই লেনিনের মধ্যে এক ধরণের শান্ত কিন্তু মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে এমন অবস্থা দেখা যায়।
পরিচালক শুরুতেই লেনিনের নরম, উদার আর যৌক্তিক মনের পরিচয় করিয়ে দেয়। সে তারই ছোটবোনকে তার ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পত্র এনে দেয় যেটা সাধারণ পুরুষতান্ত্রিক চেতনার বাইরে। কারণ বড় ভাইয়েরা সাধারণত ছোটো বোনকে সব সময় নজরদারিতে রাখতে চায় এবং নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। অথচ সেখানে সে কিনা প্রেম পত্র এনে দিচ্ছে তাও আবার এমন কারো কাছ থেকে যে কিনা কবিতা লেখে এবং যার কোনো চাল চুলো নেই। লেনিন বৃষ্টি ভালোবাসে, প্রকৃতিকে হৃদয় দিয়ে অনুভব করে, শিল্পকে কদর করতে জানে। সে ভাবতে ভালোবাসে, ভাবনায় সে অপরাধীকে পেটায় কিন্তু বাস্তবে সাহস না থাকায় অপরাধের শিকার মানুষটিকে তার সর্বস্ব দিয়ে সাহায্য করে। সে রেসকোর্সে গিয়ে দারিদ্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ফ্রি এবং শিক্ষাকে অবৈতনিক করে দিয়ে ভাষণ দেয়। তার এই ভাষণ মূলত লেনিনের সাম্যবাদী মনের অবচেতন কথা। সে তার বাবাকে তার কাজ, ইচ্ছা এবং পরিকল্পনা নিয়ে মায়ের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করে।

যাই হোক ফেরা যাক মূল কথায়। লেনিন তার বন্ধুর মাধ্যমে চাকরি পেয়ে তার দোকানে যায়। সেখানে আলাপ হয় দোকানের ম্যানেজার রবিন গোমেজ এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মনিকা বিশ্বাসের সঙ্গে। দোকানে তার কাজ হচ্ছে সারাদিন পর রাতের বেলায় দোকানটাকে সুন্দর করে সাজানো। সেখানেই কাজ করতে গিয়ে সে একটি ম্যানিকিনকে মনের মত করে সাজায়। শাড়ি পরা ওই নারী মূর্তিটি যেন শুরুর দিন থেকেই তার মনে দাগ কেটে যায়। ম্যানিকিনকে সাজানোর পর সে জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতার কয়েকটি লাইন আবৃত্তি করে। তার আবৃত্তি শেষে ঘড়ির ঘণ্টা বাজে এবং সে পেছনে তাকাতেই চমকে উঠে দেখতে পায় ম্যানিকিনটি সেখান থেকে উধাও। এরপর সে দেখতে পায় ম্যানিকিনটি একটি জীবন্ত নারীর রূপ ধারণ করেছে এবং সে তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সে ওই নারীর পিছু নেয়। মেয়েটিকে দেখা যায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত ‘আমি যে আঁধারে বন্দিনী, আমারে আলোতে নিয়ে যাও’ গানটি গাইতে। এই গানের মাধ্যমেই যেন পুরো নারী সমাজ যাদেরকে দীর্ঘ কাল ধরে পুরুষতন্ত্রের শৃঙ্খলে বেঁধে রাখা হয়েছে তাদের মুক্তি চাওয়া হয়েছে।
সেই গানের শেষে তাকে খুঁজে না পেয়ে যখন দোকানে ফিরে আসে তখন দেখতে পায় সেই নারীটি তার আগের জায়গাতেই ম্যানিকিনরূপে রয়ে গেছে। লেনিন মনে করে এটা তার বিভ্রম ছিলো। এরপর একদিন দিনের বেলা সে দোকানে যায় সেই ম্যানিকিনের টানে। সেটার চারপাশ ঘিরে এমনভাবে দেখতে থাকে মোহাবিষ্টের মতো যে দোকানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার মনিকা বিশ্বাস তাকে জিজ্ঞেস করে ফেলে ওটার প্রেমে পড়ে গেছে কিনা। তখন সে বিব্রত হয়ে মনিকাকে জিজ্ঞেস করে এর আগে এই দোকানে কোনো অবাস্তব বা আজগুবি ব্যাপার ঘটেছে কিনা। মনিকা উত্তর দেয় এমন কিছু এর আগে এখানে ঘটেনি। এর পরদিন দেখা যায় লেনিন দোকানে বসে চা/কফি পান করছে আর ওই দিকে ওই ম্যানিকিনটি আবারো জীবন্ত হয়ে উঠেছে। লেনিন একটু পাশ ঘুরতেই দেখতে পায় তাকে। এক লাফ দিয়ে চমকে ওঠে সে। তার এমন চমকে ওঠা দেখে জীবন্ত নারীটি তাকে প্রশ্ন করে ‘চাওনা তুমি আমায় মনে প্রাণে? এতো ভালোবাসা দিয়ে জাগিয়ে এখন ভয় পাচ্ছো?’ তখন লেনিন বলে না তেমনটা নয়, আসলে সে তো এর আগে কোনো পুতুলকে মানুষ হতে দেখেনি তাই। তখন মেয়েটির স্বরে অভিমানের ভাষা ফুটে ওঠে। বলে ‘আমায় কানে কানে কতো ভালোবাসার কথা বলেছো, এখন নিশ্চয়ই সব অস্বীকার করবে। করবে না কেন? তোমরা যে পুরুষ।’ তখন লেনিন তাকে শান্ত করে এবং জিজ্ঞেস করে গতরাতে সেই এসেছিলো কিনা। তখন মেয়েটি জবাব দেয় সেই এসেছিলো। কথা বলেনি কেন তবে জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয় চারটা বেজে গিয়েছিলো তাই লেনিনের সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। কারণ ভোরের আলো দেখার অধিকার এখনো সে পায়নি। মেয়েটির (লেনিন লাবণ্য বলে ডাকে) এই কথায় পুরো সমাজে নারীদের কী অবস্থা তাই ফুটে উঠেছে। তৎকালীন সময়ে সমাজে নারীদের অবস্থা বর্তমানের ন্যায় ছিলোনা। শিক্ষা, কর্ম, স্বাস্থ্য সকল দিক থেকে নারীরা পুরুষের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলো। নারীরা দিনের আলো দেখার অধিকার পায়নি এখনো এমন বক্তব্যের মাধ্যমে মূলত বোঝানো হয়েছে যে নারীরা এখনো ঘরের অন্ধকারে বন্দি। বাড়ির চার দেয়ালের বাইরে যে আলাদা একটা জগত আছে তা থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে। আর ‘তোমরা যে পুরুষ’ বাক্যের মাধ্যমে যেন নারীদের উপর পুরুষদের কর্তৃত্বমূলক আচরণকে কটাক্ষ করা হয়েছে।
তাদেরকে প্রায়ই দেখা যায় ঘরের বাইরে মাঠে-প্রান্তরে, নদীতে-নৌকায় নৈসর্গিক প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে। মাঝ নদীতে নৌকায় বসে লেনিন যখন জিজ্ঞেস করে ‘তুমি কে’ তখন ক্যামেরা জাম্প কাট করে চলে যায় বিশাল এক প্রাসাদে। তখন তাদের কথোপকথন নিম্নে তুলে ধরা হল।
লাবণ্য- কালের এক দূর দূরান্তে ছিলাম আমি, আমরা। ইতিহাস ধরে যদি ফিরে যাও আলোর গতিতে তাহলে পলকে পৌঁছে যাবে সেখানে। হেঁসে খেলে বেড়াতাম আমরা। ওই বিশাল সূর্য ছিলেন আমাদের পিতা।’
লেনিন- মানে সূর্যকন্যা?
লাবণ্য- ‘হ্যাঁ, সৃষ্টির উৎস ছিলো তারা। মুক্ত আনন্দে সুখের উল্লাসে দিন কাটতো তাদের। তারপর দেখতে দেখতে কি যেন হয়ে গেলো। যাদেরকে অন্তরের ভালোবাসা শরীরের প্রতিটি অণু পরমাণু দিয়ে তিল তিল করে সৃষ্টি করলাম, হৃদয়ে দিলাম স্পন্দন, মুখে দিলাম ভাষা তারাই একদিন রূপ নিলো ভয়ঙ্কর রাহুর। সূর্যকন্যাদের তারা বন্দি করে রাখলো কালের অন্ধকারে।’
লেনিন- তারা কারা?
লাবণ্য- শক্তিতে মত্ত পুরুষ। তার পরের ইতিহাস এক ভয়াবহ দাসত্বের ইতিহাস। তাই আজ আমাদের নেই কোনো স্বকীয়তা। আমরা কেবল সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র। ভোগের সামগ্রী।
লাবণ্যের এই বক্তব্য যেন যুগ যুগ ধরে শাসিত এবং নির্যাতিত হয়ে আসা সকল নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পরিচালক তা বুঝিয়েও দেন তার কিছুক্ষণ পরেই। দোকানে ফিরে এসে লেনিন লাবণ্যকে (লাবণ্য নামটি ঠিক হবার আগে) কী নামে ডাকবে জিজ্ঞেস করলে লাবণ্য বলে তুমিই দাওনা একটি নাম। তখন লেনিন বলে-“তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছিলো তোমায় যেন চিনি। কোথায় যেন দেখেছি। কোথাও তোমার নাম ছিলো লাবণ্য, কোথাও ইউরিটেস, তানিয়া কোথাও বা ভেনাস।” এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যায় বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দেশের নারীদের অবস্থা এতোটাই অভিন্ন যে, যে কেউ যে কোনো সমাজে থেকে তা চিনে নিতে পারে। এজন্যই লাবণ্যকে লেনিনের চেনা মনে হয় এবং তাকে একেক সময় একেক নামে ডাকতে চায়। এই কথোপকথনের সময় তাদেরকে বিশাল এক পাথরে গড়া জমিদার বাড়িতে দেখা যায়। সেখানকার বড় বড় পিলারের মাঝে লাবণ্যের উপস্থিতি যেন তার বন্দিত্বকেই প্রকাশ করে।

লাবণ্যর এই কথাগুলো লেনিনকে ভাবায়। তাই সে তার ইতিহাসে স্কলার মামার কাছে গিয়ে জানতে চায় ইতিহাসে নারীর কর্তৃত্ব পুরুষের হাতে গেলো কীভাবে। তখন তার মামা উত্তর দেয় এভাবে-“মেয়েদের হাতে কৃষি সভ্যতার পত্তন। তা প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে। পুরুষরা তখন কেবল শিকার করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু জানতো না। তারা যখন দেখল মেয়েরা শস্য এবং সন্তান দুইই উৎপাদনে সক্ষম এবং তারা কাপড়ও বুনতে পারে তখন তারা ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসেবে সমাজে মেয়েদের কর্তৃত্ব মেনে নিলো। অনেক দিন পরে একদিন পুরুষ সম্পদ বা টাকা আবিষ্কার করে বসলো। কিন্তু সঙ্গে এলো নতুন দুশ্চিন্তা। মরে গেলে এসব ভোগ করবে কে? বাচ্চা-কাচ্চা তো সব মেয়েদের। বুদ্ধি দিলো ওঝা। রানীকে দখল করো তাহলে তার সন্তান হবে তোমারই সন্তান। তোমার সম্পত্তির উত্তরাধিকার। ব্যাস, যেমন বলা তেমন কাজ।” মামার বর্ণনায় নারীর বন্দি হবার ইতিহাস একটি কার্টুনের মাধ্যমে দেখানো হয়। মানুষের ইতিহাস পুরুষের ক্ষমতা লিপ্সার ইতিহাস আর নারীর অহিংস ধর্মের ইতিহাস তারই ব্যাখ্যা যেন পাওয়া যায় লেনিনের মামার এই বক্তব্যে।

একদিকে লেনিন যখন তার কাল্পনিক নারীর মুক্তির জন্য পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বিপরীতে তার বন্ধু রাসেলকে দেখা যায় তারই দোকানের কর্মচারী মনিকা বিশ্বাসের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক তৈরি করে তাকে বিয়ে করতে অস্বীকৃতি জানাতে। যেদিন মনিকা তাদের সম্পর্কের পরিণতি কী জানতে চায় রাসেলের কাছে তখনকার কথোপকথনটি নিম্নে তুলে ধরা হল-
মনিকা: এতদিনের এসব কি তাহলে মিথ্যে?
রাসেল: নাহ্, মিথ্যে নয়। তবে বিয়ে, আর নয়। মনি, লিসেন, ভালোবাসি বলেই আমাদের
বিয়ে করা উচিত নয়।
মনিকা: কেন?
রাসেল: বিয়ের ঘানিতে সবকিছু নিংড়ে বেরিয়ে যায়। আই ডিড ইট ওয়ান্স। আই নৌ।
মনিকা: তাহলে বলে দাও কী করবো।
রাসেল: ওকে ভালো লাগলে বিয়ে করো।
মনিকা: তারপর শুধু হাড়ি ঠ্যালো আর বছর বছর বাচ্চা বিয়োও।
রাসেল: তবুও স্ত্রীর মর্যাদা পাবে। আর টাকার জন্য ভেবোনা।
মনিকা: থাক, আর অপমান করো না।

রাসেলের কথাবার্তায় বোঝা যায় যে সে নারীদেরকে শুধু ভোগের সামগ্রী হিসেবেই দেখে থাকে। সিনেমায় এর আগে দেখা যায় মনিকার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে এবং তাদের মধ্যে শারীরিকভাবেও সম্পর্ক হয়েছে অথচ মনিকা যখনই বিয়ের কথা বলেছে তখনই সে মনিকাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তার কথায় বোঝা যায় যে নারীর জন্য স্ত্রীর মর্যাদাটা পাওয়াই যেন নারীর জীবনের বড় পাওয়া। শুধু তাই নয় সে আর্থিকভাবে সাহায্য করার কথা বলে মনিকাকে অপমান পর্যন্ত করে। রাসেলের এই আচরণে কষ্ট পেয়ে মনিকা চাকরি ছেড়ে তার বাড়িতে ফিরে যায়। রাসেল মনিকাকে তার এক বছরের মাইনে দিয়ে একটি চিঠি পাঠায়। এতে মনিকা তীব্র অপমানিত হয়। সে সঙ্গে সঙ্গেই তার ভাইকে দিয়ে সেই টাকা ফেরত পাঠিয়ে চিঠি লিখে সরাসরি রাসেলের হাতে দিতে বলে। মনিকার তীব্র আত্মসম্মানবোধ এবং দৃঢ়তা তার সম্পর্কে রাসেলের ধারণা পাল্টে দেয় এবং শেষ পর্যন্ত রাসেল তার ভুল বুঝতে পেরে মনিকাকে ফেরত আনতে যায়। পরিচালক এখানে মনিকার মাধ্যমে দর্শকদেরকে বুঝিয়ে দিলেন যে মেয়েরা শুধু ভোগের সামগ্রী নয়, তারা কোনো পুরুষ নির্ভর সত্ত্বা নয় এবং নয় অর্থের লোভে পড়ে থাকা কোনো পুরুষের খেলার পুতুল।

এদিকে লেনিনকে একদিন তার মা একটি মেয়ের কথা জানায় যে কিনা লেনিনের ছোটো বোনের বান্ধবী। তার মায়ের এবং বোনের ইচ্ছা এই মেয়েকেই যেন লেনিন বিয়ে করে। তার সঙ্গে সুজলাকে, মানে তার বোনের বান্ধবীকে পরিচয় করিয়ে দিতে তাদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলে লেনিন সবাইকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যায় বাড়ি থেকে। কারণ লেনিন তো লাবণ্যকে কথা দিয়েছে তার জন্য অনন্তকাল সে অপেক্ষা করবে এবং তাকে মুক্তি দেবে। যেদিন লাবণ্য মুক্তি পাবে এবং অন্য কোনো নামে সে লেনিনের জীবনে বাস্তবেই চলে আসবে সেইদিন যেন লাবণ্যর সঙ্গে এই দিনগুলোর কথা তাকে মনে করিয়ে দেয়া না হয়। যদি মনে করিয়ে দেয়া হয় তবে লাবণ্য আবারো কালের অন্ধকারে হারিয়ে যাবে। তাই লেনিন তাকে প্রতিশ্রুতি দেয় যে কখনও তাকে মনে করিয়ে দেবে না এই দিনগুলোর কথা। এভাবেই চলতে থাকলে লাবণ্য একদিন জানায় যে তার মুক্তির দিন চলে এসেছে। আর মাত্র একদিন বাকি। পরের দিন ভোর চারটায়ই সে মুক্তি পাবে। লেনিন তাই সেই মুক্তির।সময় সেখানে তার পাশে থাকতে চায়। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনা। বন্ধুর সঙ্গে মদ খেয়ে সে অচেতন হয়ে পরে থাকে বন্ধুরই হোটেলে। সেখানে ভোর চারটার দশ মিনিটি আগে তার ঘুম ভাঙ্গে এবং সম্বিৎ ফিরেই সে দৌড়ে সেই দোকানে যায়। কিন্তু ততক্ষণে চারটা বেঁজে গেছে এবং বোঝা যায় সেখানে সে একটা দুর্ঘটনার শিকার হয়। এর কিছুক্ষণ পরেই লেনিনকে হাসপাতালে দেখা যায় এবং সেখানেই তার অবাস্তব লাবণ্য সুজলা হয়ে বাস্তবে ফিরে আসে।
সিনেমায় বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদটি আরো জোরালো হতে পারতো যদি ফ্যান্টাসির পরিবর্তে বাস্তব কোনো নারীর মাধ্যমে প্রতিবাদটি আসতো। যদিও কিছুটা সরাসরি প্রতিবাদ এসেছে মনিকা বিশ্বাসের বক্তব্যের মাধ্যমে। যেমন চিরকাল ধরে সমাজে নারীকে যেভাবে রাখা হয়েছে হেঁসেল ঠ্যালা আর সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র হিসেবে তার প্রতিবাদ করেছে সে। এই দুই কাজের বাইরে আরো যে বিস্তৃত জগত আছে মনিকা তা দেখতে চেয়েছে।

[লেখাটি চ্যানেলআই অনলাইন-এ ৩১ জুলাই ২০১৮ প্রকাশিত হয়।]