By জান্নাতুল রুহী
একটি বিজ্ঞাপন, অসংখ্য প্রশ্ন : শিশুর ভবিষ্যৎ কি তবে স্ক্রিনেই?
Media School December 7, 2025
গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনটিতে যা দেখানো হয়েছে, তা কি সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাভাবিক?
দোলনায় শুয়ে থাকা শিশুটির দোলনারই স্ট্যান্ডে রাখা মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা বাবার গান-দৃশ্যটা দেখতে যতটা মধুর, ঠিক ততটাই উদ্বেগজনক। এক বছরের কম বয়সী শিশুর হাতের কাছে মোবাইল পৌঁছানোর বিজ্ঞাপন কী বার্তা দিচ্ছে আমাদের সমাজকে?
ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার টেস্ট ম্যাচ দেখছিলাম, ওভার শেষে একটি নতুন বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল। গ্রামীণফোনের ইন্টারনেটের ওই বিজ্ঞাপনে দেখা গেল, দোলনায় শুয়ে থাকা ছোট্ট শিশুকে বাবা ভিডিও কলের মাধ্যমে ঘুম পাড়াচ্ছেন ‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে’ গানটি গেয়ে। বাবা তখন অফিসের উদ্দেশ্যে বাইরে, তাই মোবাইলের স্ক্রিনে শিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।
বাবার গান শুনে শিশুটি ঘুমিয়ে পড়লেও তার মায়ের ঘুম ভেঙে গেল। দোলনার কাছে এসে শিশুটি ঘুমিয়ে গেছে বোঝার পর ওর মা সন্তুষ্টির সঙ্গে মোবাইলটি হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘কী?’ বাবা রসিকতাচ্ছলে উত্তর দেন, ‘একজনকে ঘুম পাড়ালাম, আরেকজন দেখি ওঠে চলে আসছে।’ শিশুর মা হাসি মুখে বললেন, ‘তুমি তো সত্যিই ভালো বাবা হয়ে গেছ!’
বিজ্ঞাপনটির চমৎকার দৃশ্যায়ন পারিবারিক আবেগকে প্রাণবন্তভাবে উপস্থাপন করার জন্য প্রশংসা পেতে পারে। তবে, তা করতে পারছি না বলে দুঃখিত। গ্রামীণফোনের এই বিজ্ঞাপন শুধু আবেগই ফুটিয়ে তুলছে না-এটি এক অদৃশ্য বার্তাও ছড়িয়ে দিচ্ছে, যা আমাদের বিচলিত হতে বাধ্য করে। বার্তাটি এমন, যেন স্ক্রিনটাইম শিশুর জন্য খুবই স্বাভাবিক এবং নিরাপদও। কিন্তু এক বছরের কম বয়সী শিশুকে ঘুম পাড়াতে মোবাইল ব্যবহার কতটা নিরাপদ? বিজ্ঞাপন কি শুধুই মধুর মুহূর্ত দেখাচ্ছে, না কি এতে লুকিয়ে আছে শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক অশনি সংকেত?
সুসংগঠিত পারিবারিক আবহের মধ্যে বিজ্ঞাপনটি আসলে আমাদের কী বার্তা দেয়? আমরা ভাবতে প্ররোচিত হই, শিশুর দৈনন্দিন কিংবা প্রাত্যহিক কাজে মোবাইল ব্যবহার খুবই স্বাভাবিক। বিজ্ঞাপনের অদৃশ্য এই বার্তাটা, অর্থাৎ এক বছরের কম বয়সী একটা শিশুর কাছে মোবাইল ব্যবহারের এই স্বাভাবিকীকরণ প্রক্রিয়াটাই আমার কাছে সবচেয়ে অস্বাভাবিক ঠেকেছে। বলা বাহুল্য, পরিবারই শিশুদের মোবাইলনির্ভর করে তোলে-এই বিজ্ঞাপনটি সেটার উৎকৃষ্ট উদাহরণও বটে।
বিজ্ঞাপন থেকে মূলত দুটি ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমত, মা ঘুমাচ্ছেন এবং শিশুটি দোলনায় - অর্থাৎ এখনো হাঁটতে শেখেনি। তাই বাবা অফিসের জন্য বের হওয়ার আগে মোবাইলটি দোলনায় চালু করে রেখে গেছেন। দ্বিতীয়ত, পরিবারে আর কোনো ব্যক্তি নেই; অর্থাৎ বিজ্ঞাপনে দেখানো পরিবারটি একটি একক পরিবার। এজন্যই শিশুর মা যেন কিছুটা সময় বিশ্রাম নিতে পারে - এটি বিবেচনা করেই মাকে না জাগিয়ে শিশুটির কাছে মোবাইল চালু করে দিয়ে গেছে তার বাবা। এখানেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে একটি অদৃশ্য বার্তা প্রতিফলিত হচ্ছে- শিশুর প্রয়োজনীয়তাগুলো মোবাইলের মাধ্যমে পূরণ করা যায়, যা বাস্তব জীবনের দিক থেকে উদ্বেগজনক।
২.
একটা শিশুকে মোবাইল তথা অন্য যে-কোনো প্রযুক্তির সান্নিধ্যে নেওয়া, না-নেওয়া, নিলে কতটুকু নেওয়া, কিংবা কখন থেকে নেওয়া - এই পাঠগুলো আসলে সন্তানের জন্ম এবং বেড়ে ওঠার ধাপগুলোর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করানোর পর এই অভিজ্ঞতাগুলো আমার কাছে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দিয়েছে। অনেক শিশুকে দেখেছি, মোবাইল বুকে জড়িয়ে ধরে ক্লাস করতে এসেছে! অনেক অভিভাবককে বলতে শুনেছি, মোবাইল ছাড়া তার সন্তান খায় না, গোসল করে না, এমনকি পড়তে বসলেও মোবাইলে কীভাবে পড়াচ্ছে- সেটা না দেখালে লিখতে-পড়তে চায় না।
এসবের মধ্যে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ও উদ্বেগজনক ঘটনা ছিল একটি শিশুকে তার অস্বাভাবিক আচরণের কারণে স্কুল থেকে বাদ দেওয়া। বাচ্চাটি প্রচণ্ড অস্থির ছিল এবং ক্লাসে সবকিছুই ইশারার মাধ্যমে বোঝানোর চেষ্টা করত। নার্সারির সেই শিশুর মা আমাকে বলেছিলেন, তিনি নিজে কখনোই সন্তানের খাওয়া, গোসল, ঘুম বা অন্যান্য দৈনন্দিন যত্নের কাজগুলো করেননি। তিনি কোনো চাকরিজীবীও নন। তবু শিশুটি সবসময়ই গৃহকর্মীর তত্ত্বাবধানে ছিল এবং এই গৃহকর্মীই শিশুর যাবতীয় কাজের দায়িত্ব নিতেন। এমন অবস্থায় মাতৃস্নেহের অভাব এবং অতিরিক্ত মোবাইল নির্ভরতা একত্রে শিশুর মানসিক ও সামাজিক বিকাশকে বিপর্যস্ত করেছে।
যে শিশুর হাতে প্রথমে মোবাইল ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, সে ক্রমে সম্পূর্ণ মোবাইল-নির্ভর হয়ে ওঠে। শিশুটি মনে করতে থাকে, কথা বলার প্রয়োজন নেই - মোবাইল গেমের মতোই সব কাজ মুহূর্তেই হয়ে যায়। এজন্য সে সব কথা বলা শুরু করে ইশারা করে! সে মনে করে, মোবাইলের ক্লিকের মতোই সব কাজই মুহুর্তেই হয়ে যায়! সে ইশারা দিয়ে কাউকে পানি আনতে বললে সেই পানি আনার জন্য সময় লাগে সেই ব্যবধান অনুধাবন করতে পারে না। এর ফলে সে আগ্রাসী আচরণ প্রকাশ করতে থাকে।
আমাদের বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা এবং সেটার এখনো যথার্থ সমাধান না বের করা, কিংবা বের করার আন্তরিক কোনো উদ্যোগ না নেওয়ার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে গ্রামীণফোনের এই বিজ্ঞাপনটা পরোক্ষভাবে সেই সমস্যাকেই আরও ঘনীভূত করার জন্য যেন উসকানিমূলক বার্তাই দিল।
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো শিশুদের অতিদ্রুত স্ক্রিন-নির্ভর হয়ে ওঠা, যার যথাযথ সমাধান এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি এবং আন্তরিক কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। এই প্রক্রিয়াতেই গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপনটি পরোক্ষভাবে সেই সমস্যাকে আরও ঘনীভূত করছে; এতে শিশুদের মোবাইল ব্যবহারকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
৩.
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এবং আমেরিকান একাডেমি অফ পেডিয়াট্রিকস (AAP)-এর নির্দেশনা অনুযায়ী:
১. এক বছরের নিচের শিশুদের জন্য স্ক্রিন ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। দুই বছর বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেও স্ক্রিন সময় দিনে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা হতে পারে, তবে কম হলে আরও ভালো (WHO, 2019)।
২. ১৮-২৪ মাস বয়সী শিশুদের জন্য ভিডিও চ্যাট ছাড়া অন্য কোনো ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহার এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে শুধুমাত্র উচ্চমানের কোনো প্রোগ্রাম ব্যবহার করা যেতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- শিশুকে কখনোই একা স্ক্রিনের সামনে বসানো যাবে না; অভিভাবককে তার সঙ্গে একসঙ্গে বসে ব্যবহার করতে হবে (AAP, 2016)।
এই নির্দেশনাগুলো স্পষ্টভাবে বলে দেয়, বিজ্ঞাপনে দেখানো স্ক্রিন-নির্ভর প্যারেন্টিং শুধু অনুপযুক্তই নয়, বরং আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য নির্দেশনার সরাসরি বিরোধিতা করে।
মনে প্রশ্ন আসে, গ্রামীণফোন এই বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট তৈরি করার সময় কি এই নির্দেশনাগুলো সম্পর্কে অবগত ছিল না? বিভিন্ন সংবাদ, বিজ্ঞাপন থেকে জেনেছি গ্রামীণফোন, টেলিনর গ্রুপ ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে ‘বি স্মার্ট ইউজ হার্ট’ শিরোনামে শিশুদের জন্য একটা অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ক সচেতনতামূলক কর্মসূচি আছে। এর মাধ্যমে শিশুদের অনলাইন জগতের বিপদগুলো সম্পর্কে বোঝানো, সচেতন করা এবং কীভাবে নিরাপদভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে হবে- এ সম্পর্কে শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং অভিভাবকদের দক্ষতা ও জ্ঞান বৃদ্ধি করা হয়। এই কর্মসূচির আওতায় অনেকেই প্রশিক্ষণ পেয়েছেন।
কিন্তু যখন দেখা যায়, কোম্পানি সচেতনতার প্রশিক্ষণ দিচ্ছে, সেই সঙ্গে আরেকটি বিজ্ঞাপন তৈরি করা হচ্ছে যা একেবারেই বিপরীত বার্তা পাঠাচ্ছে - এতে অন্তর্নিহিত দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। এতে প্রশ্ন আসে, গ্রামীণফোন কি শুধুমাত্র ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ার জন্য সচেতনতা প্রচারে যুক্ত হয়েছে, নাকি তারা প্রকৃতভাবে শিশুর উত্থান ও নিরাপদ ডিজিটাল বিকাশকে গুরুত্ব দিচ্ছে?
তাহলে ধরে নেওয়াই যায়- গ্রামীণফোন খুব ভালো করেই জানে এই নির্দেশনাগুলো কী এবং কেন এগুলো গুরুত্বপূর্ণ। তা-সত্ত্বেও প্রশ্ন জাগে, বিজ্ঞাপনটির গল্প এমনভাবে তৈরি করা হলো কেন? আজ যখন ডিজিটাল মিডিয়া ব্যবহারের সীমা, শিশুদের স্ক্রিন-টাইম নিয়ন্ত্রণ, কোন আচরণ উপযোগী বা অনুপযোগী, ডিভাইসকেন্দ্রিক অফিস সংস্কৃতির চাপ, একক পরিবারেরর প্রবণতা, মা-বাবার ব্যস্ততা - সবকিছু নিয়েই সাধারণ মানুষ দোটানার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে; তখন দেশের সবচেয়ে বড় ও প্রযুক্তিসচেতন টেলিকম অপারেটর শুধুই ব্যবসায়িক বিবেচনায় এমন অসংবেদনশীল বার্তা ছড়িয়ে দেবে, এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন।
দয়া করে, এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সংকটকে ব্যবসা, ব্র্যান্ডিং, ডোনার বা ফান্ড পাওয়ার হিসাব-নিকাশের দিকে টেনে নিয়ে যাবেন না। আজকের শিশুই দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী, সমাজ-নির্মাতা। তাই, তাদের চারপাশে আমরা কেমন বার্তা ছড়িয়ে দিচ্ছি, তাদের অনলাইন অভ্যাস আমরা কীভাবে গড়ে তুলছি- এটা শুধু নীতিগত প্রশ্ন নয়; এটা দেশের দীর্ঘমেয়াদি কাঠামো, মানসিক স্বাস্থ্য ও নৈতিক বিকাশের প্রশ্ন।
জান্নাতুল রুহী : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এ, ১৯ নভেম্বর ২০২৫। লেখকের সম্মতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।

