Media School

Dhaka    Wednesday, 30 April 2025

By জান্নাতুল ফেরদৌস

কেউ আমাকে থামাতে পারেনি

Media School October 22, 2020

জান্নাতুল ফেরদৌস : শিক্ষার্থী, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ, সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটি।

আমাদের গ্রামে মেয়েদের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যায়। যদিও আমার বাবা আমাকে কম বয়সে বিয়ে দিতে আগ্রহী ছিলেন না; তার স্বপ্ন ছিল আমাকে অনেক লেখাপড়া করাবেন যাতে আমার নিজের একটা আলাদা পরিচয় হয়। কিন্তু হঠাৎই পরিস্থিতি অনেককিছু বদলে দেয়। শৈশব কাটিয়ে মাত্র কৈশোরে পা দিয়েছি, এমন সময় বাবার অসুস্থতার কারণে হঠাৎ করেই আমাকে বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাবার শুধু একটাই ইচ্ছা ছিল, আমাকে যেখানেই বিয়ে দেবে, তারা যেন আমাকে লেখাপড়া করায়। খেলার ছলেই একদিন হুট করেই সত্যিকারের বউ সাজানো হল আমাকে। কিছু বুঝতে পারছিলাম না। বিয়ে বিয়ে শুনতে শুনতে একদিন সত্যি সত্যি বিয়ে হয়ে গেলো আমার।

তখন মাত্র নবম শ্রেণি শেষ করেছি। বিয়ের আগে আমার স্বামী কথা দিয়েছিলেন যে বিয়ের পরও আমি যেই পর্যন্ত চাইবো তিনি আমাকে পড়তে সাহায্য করবেন। কথা ছিল এসএসসি পরীক্ষার পরে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়ে যাওয়া  হবে। দুরন্ত সেই আমি হুট করেই কেমন যেন শান্ত হয়ে গেলাম। বাড়িতে থাকতাম, স্কুলে যেতাম আর মাঝে মাঝে স্বামী আমাকে দেখতে আসতেন - এভাবেই চলছিলো। কিছুদিন পর চলে এলাম স্বামীর সংসারে।

আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেলো, বাবা প্রথম দিন আমার সাথে দেখা করে আমার পছন্দের খাবার-দাবার কিনে দিয়ে গেলেন। দ্বিতীয় দিন পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আব্বুর (শ্বশুর) মুখে শুনি, বাবা স্ট্রোক করেছেন। এরপর প্রতিটি পরীক্ষায় দেরি করে যেতে হতো আমার, কারণ সারা রাত হাসপাতালে থাকতে হতো আমাকে। পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। ১০ এপ্রিল ২০১৪ বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। এবার কিছু মানুষের নতুন রূপ আবিষ্কার করলাম। শুধু আব্বু (শ্বশুর) আর আমার স্বামী ছাড়া শ্বশুরবাড়ির আর কেউ চাইতো না, আমি আর লেখাপড়া করি। তাদের মতে, বাড়ির বউয়ের এত পড়াশোনা না করলেও চলে; বাচ্চা পালন করার জন্য যতটুকু দরকার, ওইটুকু হলেই হয়।

শাশুড়ি বললো, 'এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, ব্যস হয়ে গেছে, এবার সংসারে মন দিবে। দিন-কাল খারাপ, কলেজে ভর্তি করলে কোন কুকাজ করে বসে ঠিক নাই।' আমার স্বামীকেও বলতো, 'হয়েছে, বউকে এত লাই দিও না, পরে অমুকের বউয়ের মত পালিয়ে যাবে, মান সম্মান থাকবে না।'

পরীক্ষার ফলাফল পেলাম, খুব ভালোভাবেই পাস করলাম। এরপর ভর্তি নিয়ে চলছিলো রাজনীতি। তবে শ্বশুরের সহযোগিতায় আলাদা বাসা নিলাম আমরা। কলেজে ভর্তি হলাম। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় আমি গর্ভধারণ করলাম। সন্তানকে পেটে নিয়েই চলছিলো লড়াই। কিন্তু এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হলো যখন আমার গর্ভাবস্থার আট মাস। প্রথম পরীক্ষার দিনই আমি খুব অসুস্থ হয়ে গেলাম। ডাক্তার বলল, বিশ্রামে থাকতে হবে নয়তো সন্তানের ক্ষতি হবে। বুঝতে বাকি রইলো না, আমার আর পরীক্ষা দেওয়া হবে না। সেদিন প্রথম বুঝতে পারি, পড়ালেখার প্রতি আমার কত ভালবাসা। চিৎকার করে কেঁদেছিলাম সেদিন।

সন্তানের যখন ছয় মাস বয়স, একদিন শাশুড়ি ডেকে বললেন, 'পাগলামি বাদ দাও, বাচ্চাটা হয়েছে ওকে ঠিকমত দেখাশুনা করো। আবার পড়ালেখা শুরু করো না।' ক্লাস করতে না পারলেও স্বামীর সহযোগিতায় সবার আড়ালে পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম। মা আর বোনের কাছে সন্তানকে রেখে রেখে পরীক্ষা দিতে যেতাম। অনেক কষ্টের পর কলেজ থেকে ফোন পেলাম, আমি পাস করেছি। এরপর আমার স্বামী বললেন, 'সবাইকে বলে দাও তুমি পেরেছো। আর কোন লুকোচুরি হবে না।'

শত চেষ্টার পরও কেউ আমাকে থামাতে পারেনি। হয়ত স্রষ্টা চাননি আমি থামি, তিনি চান আমি এগিয়ে যাই, নারী এগিয়ে যাক। এই যুদ্ধে আমার সাথে আমার স্বামী সহযোদ্ধা ছিলেন, তিনি আমাকে এতটা যুদ্ধ জয় করতে সাহস জুগিয়েছেন। এভাবে আমি প্রতিটি যুদ্ধ জয় করতে চাই।