Media School

Dhaka    Wednesday, 24 April 2024

By সজীব সরকার

গণমাধ্যমের দায়িত্ব বা কাজের পরিধি

Media School July 20, 2020

জনকল্যাণে কাজ করতে হলে গণমাধ্যমকে হতে হবে দায়িত্বশীল। ছবি : excelmedia.in

গণমাধ্যমের দায়িত্ব বা কাজ কী হবে আর কী হবে না, এ নিয়ে যুগে যুগে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। এসব আলোচনা-সমালোচনা থেকে আমরা বলতে পারি, গণমাধ্যম সার্বিকভাবে এই দায়িত্বগুলো পালন করছে বা করবে :

 

  • তথ্য জানানো (to inform) : গণমাধ্যমের প্রধান কাজ হচ্ছে মানুষকে তথ্য জানানো। দেশ-বিদেশে যা ঘটছে, সেসব সম্পর্কে জরুরি তথ্য সাধারণ মানুষের জানার প্রয়োজন থাকে। এই প্রয়োজন মেটানো গণমাধ্যমের প্রধানতম দায়িত্ব বলে মনে করা হয়। কবে ভোট, কবে আয়কর দিতে হবে, দেশে কী রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে আর কীভাবে তা মোকাবেলা করতে হবে - ইত্যাদি তথ্য গণমাধ্যম মানুষকে জানায়।
  • শেখানো (to educate) : তথ্য জানানোর পাশাপাশি গণমাধ্যম অনেকসময় শিক্ষামূলক অনেক সংবাদ, ফিচার বা অন্য আধেয় (content) প্রকাশ বা প্রচার করে থাকে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানাবিধ বিষয় সম্পর্কে শেখার ব্যাপারটি ঘটে। নাটক, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন, প্রজ্ঞাপন, সংবাদ ইত্যাদির মাধ্যমে নানাভাবে শিক্ষামূলক বার্তা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। ডায়রিয়া থেকে বাঁচতে হলে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে; ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে এবং পরে বুকের দুধের পাশাপাশি ফলমূল, মাছ-মাংস-ডিম ও শাকসবজি খাওয়াতে হবে; প্রসূতি মায়ের যত্ন; শিশুকে কাজে না পাঠিয়ে তাদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে - ইত্যাদি বিষয় নানাভাবে মানুষকে শেখানো হয়।
  • সচেতন করা (to create awareness) : গণমাধ্যম নানাভাবে বার্তা দেয়ার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করে। শীতে বা গরমে সুস্থ থাকার জন্যে করণীয়, জাল ভোটের বিরুদ্ধে সতর্কতা, জঙ্গি কর্মকাণ্ড থেকে বাঁচা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সুরক্ষা - ইত্যাদি বিষয়ে গণমাধ্যম বিভিন্ন উপায়ে বার্তা দেয়ার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে।
  • প্রভাবিত করা (to persuade) : জনগণকে একটি বিশেষ ইস্যুতে প্রভাবিত করাও গণমাধ্যমের আরেকটি কাজ। দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের শাসন নিশ্চিত করা কিংবা শিশু নির্যাতন, বাল্যবিয়ে বা যৌতুকের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করা গণমাধ্যমের কাজ।
  • সংবাদের বিশ্লেষণ (to interprete news or facts) : বড় কোনো ঘটনা - জনজীবনে যার প্রভাব ব্যাপক কিংবা যেসব ইস্যুতে জনসাধারণ বিশেষজ্ঞ মতামত প্রত্যাশা করে, সেগুলোর ক্ষেত্রে গণমাধ্যম এসব বিষয়ে সংবাদ বা পর্যবেক্ষণ প্রকাশের মাধ্যমে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ উপস্থাপন করে। টেলিভিশনের টক-শোগুলো এই প্রয়োজন অনেকাংশেই পূরণ করে।
  • নীতি-নির্ধারণে সহায়তা করা (to assist and encourage policy decisions) : সরকার বা নীতি-নির্ধারণী মহলে অনেক ইস্যুই আলোচিত হয়। সেগুলোর কোনটা জনগণের জন্যে মঙ্গলজনক হবে আর কোনটা হবে না কিংবা জনগণ কী চাচ্ছে আর কী চাচ্ছে না - সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে এসব বিষয় নিয়ে ভাবনা-চিন্তার দরকার থাকে। এসব ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলো নীতি-নির্ধারক ও জনগণ - উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে।
  • পরিবর্তনকে প্রভাবিত বা উৎসাহিত করা (to influence change) : দেশের আর্থ-সামাজিক বা সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে দরকারি পরিবর্তন আনার জন্যে গণমাধ্যমগুলো নানা উপায়ে জনসাধারণ ও নীতি-নির্ধারকদের উৎসাহিত করে।
  • জনমত গড়ে তোলা (to shape public opinion) : কোনো বিষয়ের পক্ষে বা বিপক্ষে জনমত গড়ে তোলাও গণমাধ্যমের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। যেমন : জঙ্গিবাদের বিপক্ষে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এবং বিজ্ঞানমনস্ক একটি উদার রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে গণমাধ্যমগুলোকে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
  • বিনোদন দেয়া (to entertain) : মানুষের জীবনে বিনোদনের প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কালের স্রোতে সময়ের বাস্তবতায় মানুষ নানাবিধ চাপের মধ্যে বা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে থাকে। আবার সংবাদমাধ্যমেও নেতিবাচক খবর অনেক বেশি থাকে। সব মিলিয়ে মানুষ স্বস্তি খুঁজে ফেরে; একটু বিনোদন মানুষের মনে অনেকটাই স্বস্তি ফিরিয়ে দেয়। তাই গণমাধ্যমগুলো মানুষকে বিনোদন দিতে চায়। এজন্যে গণমাধ্যমগুলো হার্ড নিউজের পাশাপাশি ফিচার, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির খবর, নাটক-সিনেমা বা সেলিব্রিটিদের নানা খবর এমনকি অনেক সময় অনেক গুজব-গুঞ্জনও প্রকাশ ও প্রচার করে।
  • প্রচার বা বিজ্ঞাপন করা (to advertise) : কোনো প্রতিষ্ঠানের পণ্য বা সেবার প্রচার বা প্রসার ঘটানোর কাজেও গণমাধ্যম সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। এ থেকে ওই প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যম - উভয়ই লাভবান হয়; বিজ্ঞাপন বর্তমান সময়ে গণমাধ্যমের আয়ের অন্যতম বড় উৎস- গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের একটি বড় অঙ্কের অর্থ সঙ্কুলান হয় বিজ্ঞাপন প্রকাশ বা প্রচার বাবদ আয় থেকে। আর বিজ্ঞাপন প্রচারের ফলে ওই প্রতিষ্ঠানেরও ব্যবসার প্রসার ঘটে। এছাড়া জনগণও এসব বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নানাবিধ পণ্য ও সেবা সম্পর্কে জানতে পারে।
  • নজরদারি করা (to watchdog) : সমাজের নানা ক্ষেত্রে সবকিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে কিনা, তার দেখ-ভাল করাও গণমাধ্যমের একটি দায়িত্ব। কোথাও কোনো অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তাই গণমাধ্যমগুলো এ বিষয়ে খবর প্রকাশে তৎপর হয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, এক ধরনের কুকুর থাকে যারা কেবল খায়-দায় আর তার মালিকের কোলে বসে থাকে; এদেরকে বলা হয় ল্যাপ-ডগ (lap-dog)। আরেক ধরনের কুকুর থাকে, যারা বাড়িতে সতর্ক পাহারা দেয়; এরা হলো ওয়াচডগ (watch-dog)। বলা হয়, গণমাধ্যমগুলো বিশ্বস্ত পাহারাদারের মতো সমাজ ও রাষ্ট্রের ভালো-মন্দের ব্যপারে অতন্দ্র প্রহরীর মতো সতর্ক পাহারায় থাকবে। এজন্যে গণমাধ্যমের কাজকে অনেক সময় 'watchdog role'-ও বলা হয়।
  • জ্ঞানের প্রবাহ প্রজন্মান্তরে চলমান রাখা (to transmit knowledge from one generation to another) : একটি সমাজের একটি নির্দিষ্ট সময়ের জ্ঞান তথা তখনকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেয়াও গণমাধ্যমের কাজ। ভাষা আন্দোলন বা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রতিবছর নিয়ম করে সংবাদ বা ফিচার প্রকাশিত হচ্ছে; গল্প-উপন্যাস লেখা হচ্ছে; নাটক বা চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে। এটি না করলে একসময় এই ইতিহাস-ঐতিহ্য হারিয়ে যেতো। পুরোনো প্রজন্মের দিনকাল বা ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম এভাবেই জানতে পারে এবং প্রজন্মান্তরে তা টিকে থাকে।

তবে মনে রাখতে হবে, দায়িত্ব পালনে গণমাধ্যমকে নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে, বৃহত্তর জনস্বার্থে ভূমিকা রাখা যায় - এমনভাবে কাজ করতে হবে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যেতে পারে, গণমাধ্যমের এই কাজগুলোকে আমরা গণযোগাযোগের উদ্দেশ্য হিসেবেও বিবেচনা করতে পারি।