Media School

Dhaka    Thursday, 25 April 2024

By সজীব সরকার

চলচ্চিত্রে ক্যামেরার ১০ কৌশল

Media School January 28, 2021

ক্যামেরার বৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যবহার ভিডিওচিত্রে নান্দনিকতা বাড়ায়।

স্থিরচিত্র বা স্টিল ফটোগ্রাফির কৌশল উদ্ভাবনের পর ক্রমান্বয়ে আরো ছোট ছোট প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও কৌশল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে একসময় গতিচিত্র বা চলচ্চিত্র তথা মোশন পিকচার বা প্রচলিত অর্থে ভিডিও ধারণের কৌশল আয়ত্তে আনা সম্ভব হয়। ভিডিও ধারণের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের পর একেবারে শুরুর দিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্যামেরা একটি নির্দিষ্ট স্থানে স্থির রেখে সম্পূর্ণ দৃশ্য বা ফুটেজ ধারণ করার চল ছিলো। একসময় ক্যামেরাকে তার নির্দিষ্ট জায়গাটি থেকে সরিয়ে নানা স্থানে বসিয়ে ভিডিও ধারণের চর্চা শুরু হয় এবং এতে ভিডিওচিত্রে দারুণ বৈচিত্র্য দৃশ্যমান হয়। এরপর থেকে চলচ্চিত্রকাররা ক্যামেরাকে নানা কৌশলে নড়াচড়া করিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে থাকেন এবং এভাবে চলচ্চিত্রের দৃশ্যে বৈচিত্র্য ও ভিন্ন ভিন্ন অর্থ সংযোজন করা সম্ভব হয়।

কালক্রমে ক্যামেরা নড়াচড়ার বা ক্যামেরা চালনের নানা নিয়ম চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল ব্যবহৃত হয়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে :

১. জুম (Zoom) : ক্যামেরাকে তার নিজের অবস্থানে স্থির রেখে লেন্সকে কাজে লাগিয়ে ফ্রেমের ভেতর সাবজেক্টকে কাছে নিয়ে আসা বা দূরে নিয়ে যাওয়া হলো জুম করা। সাবজেক্টকে কাছে এনে দেখানোকে বলা হয় ‘জুম ইন’ আর দূরে নিয়ে যাওয়াকে বলে ‘জুম আউট’। সাবজেক্ট বা সাবজেক্টের কোনো অংশ কিংবা ঘটনার কনটেক্সটকে বেশি স্পষ্ট বা গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে এই কৌশল ব্যবহার করা হয়। অনেক সময় দ্রুতগতিতে জুম ইন বা জুম আউট করে গতিশীলতা বা টেনশন বা এ ধরনের অনুভূতি তৈরি করা হয়। জুমের ক্ষেত্রে ক্যামেরার অবস্থানের কোনো নড়চড় হয় না।

২. ডলি (Dolly) : ক্যামেরার লেন্সে পরিবর্তন না ঘটিয়ে অনেক সময় ক্যামেরাটিকেই আস্তে আস্তে সাবজেক্টের কাছে নিয়ে গিয়ে তাকে ফ্রেমের ভেতরে কাছে থেকে দেখানো হয় অথবা সাবজেক্ট থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে আরো বড় ফ্রেমের ভেতর তাকে দেখানো হয়; এটি হলো ডলি। ক্যামেরাকে সাবজেক্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হলো ‘ডলি ইন’ এবং সাবজেক্ট থেকে দূরে নিয়ে যাওয়া হলো ‘ডলি আউট’। ক্যামেরা এভাবে সামনে বা পেছনে অর্থাৎ সাবজেক্টের কাছে বা দূরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রেললাইনের মতো দেখতে একধরনের ট্র্যাক অথবা কোনো যানবাহন (যেমন : প্রাইভেট কার বা মোটর সাইকেল) ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এ ধরনের শটের মাধ্যমে দৃশ্যে গতিশীলতা আনা সম্ভব হয়।

৩. ট্রাক (Truck) : এটি অনেকটাই ডলি-এর মতো; পার্থক্য শুধু এই যে, ডলি হলো ক্যামেরাকে সামনে বা পেছনে সরিয়ে নিয়ে আসা আর ট্রাক হলো বামে (ট্রাক লেফট) বা ডানে (ট্রাক রাইট) সরিয়ে নেওয়া। এই কৌশলের মাধ্যমেও দৃশ্যে গতি সংযোজন করা যায়।

৪. প্যান (Pan) : ক্যামেরা তার নিজের অবস্থানে স্থির রেখে আনুভূমিকভাবে কেবল বামে বা ডানে ঘোরানোকে প্যান বলে। ক্যামেরা বামে ঘোরানো হলো ‘প্যান লেফট’ আর ডানে ঘোরানো হলো ‘প্যান রাইট’। ব্যাপারটি অনেকটা এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমাদের পুরো শরীর স্থির রেখে শুধু মাথা বামে বা ডানে ঘোরানোর মতো। ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্স বা ওয়াইড শট ব্যবহার না করেও এ ধরনের শটের মাধ্যমে ক্যামেরাকে এক জায়গায় স্থির রেখেই সাবজেক্টের আশপাশের জায়গা বা দৃশ্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া যায়। গল্প বা ঘটনার স্থান বা লোকেশন সম্পর্কে দর্শককে ধারণা দিতে বা এ ধরনের প্রয়োজনের সময় প্যান ব্যবহার করা যেতে পারে।

৫. টিল্ট (Tilt) : ক্যামেরাকে একটি অবস্থানে স্থির রেখে শুধু ওপরে বা নিচে নড়াচড়া করানোকে টিল্ট বলে। আমরা এক জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে শুধু মাথা উঁচু করে যেভাবে আকাশ বা মাথা নিচু করে মাটি দেখি, ব্যাপারটি এমনই। ক্যামেরা ওপরের দিকে ঘোরানো হলো ‘টিল্ট আপ’ আর নিচের দিকে ঘোরানো হলো ‘টিল্ট ডাউন’। এই কৌশলের মাধ্যমে অনেক সময় একটি দৃশ্যে গুরুত্বপূর্ণ কোনো চরিত্রকে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দর্শকের সামনে তুলে ধরা হয়।

৬. রোল (Roll) : ক্যামেরা একটি জায়গায় স্থির রেখে বামে বা ডানে কাত করে দৃশ্য ধারণ করা হলো রোল। আমরা যদি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা সামনের দিকে সোজা রেখে কেবল বামে কাত করে বাম কান বাম কাঁধের সাথে কিংবা একইভাবে মাথা ডান পাশে কাত করে ডান কান ডান কাঁধে লাগানোর চেষ্টা করি, তাহলে যা ঘটবে, ক্যামেরার ক্ষেত্রে তা-ই হলো রোল। দর্শকের মনে অস্বস্তির অনুভূতি তৈরি বা কোনো সাবজেক্ট গড়িয়ে কিংবা উল্টে যাওয়ার দৃশ্য আরো বাস্তবিক করে তুলতে ওই সাবজেক্টের সাথে সাথে ক্যামেরাকেও ডানে বা বামে কাত (রোল) করা যেতে পারে।

৭. পেডেস্টাল (Pedestal) : উলম্ব বা লম্বালম্বিভাবে এক বিন্দুতে স্থির রেখে সম্পূর্ণ ক্যামেরা ওপরে উঠিয়ে নেওয়া হলো ‘পেডেস্টাল আপ’ আর নিচে নামিয়ে আনা হলো ‘পেডেস্টাল ডাউন’। উচ্চতা কম-বেশি করা যায় - এমন ট্রাইপড বা এ ধরনের কোনো স্ট্যান্ড ব্যবহার করে এমন কৌশল প্রয়োগ করা যায়। এই কৌশলের মাধ্যমে ওপর থেকে নিচ বা নিচ থেকে ওপরে ক্যামেরা ওঠা-নামা করে অনেক বেশি উঁচু কোনো সাবজেক্টের সম্পূর্ণ অংশ ক্রমান্বয়ে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা যায়। ফ্যাশন বা গ্লামার বিষয়ক ভিডিওচিত্র ধারণের ক্ষেত্রেও অনেক সময় একজন মডেলের পোশাক বা শারীরিক গঠন ফুটিয়ে তুলতে এই কৌশলে তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ক্যামেরা ওঠা-নামা করে।

৮. র‌্যাক ফোকাস (Rack Focus) : অনেক সময় একটি দৃশ্যের শুরুতে দর্শকেরা কোনো সাবজেক্ট (বা সম্পূর্ণ পর্দা) অস্পষ্ট (ব্লার বা ডি-ফোকাস) দেখতে পায় এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই পর্দায় ওই সাবজেক্ট ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই কৌশলের নাম হলো র‌্যাক ফোকাস। ফ্রেমের ভেতরে বা পর্দায় কখনো কখনো পাশাপাশি অবস্থানে থাকা দুটি সাবজেক্টের একটি ফোকাসে (স্পষ্ট) থাকে এবং অন্যটি ডি-ফোকাসে (অস্পষ্ট) থাকে এবং কিছুক্ষণ পরই ফোকাস বদল করে প্রথমটিকে অস্পষ্ট ও পরেরটিকে স্পষ্ট করে তোলা হয়। এটিও র‌্যাক ফোকাস। দর্শকের মনোযোগ একটি সাবজেক্ট থেকে সরিয়ে অন্যটিতে নিয়ে যেতে এই কৌশল বেশ কার্যকর। র‌্যাক ফোকাসে ক্যামেরার অবস্থানের কোনো নড়চড় হয় না।

৯. জার্ক (Jerk) : কোনো দৃশ্য ধারণের সময় সাধারণত চেষ্টা করা হয় ক্যামেরা যেন ঝাঁকুনি না খায় বা না নড়ে। ক্যামেরা অযথা নড়ে গেলে দৃশ্যটি যেমন অস্পষ্ট হয়, দর্শকও দেখতে বিরক্তি বোধ করে। এজন্যে ট্রাইপড বা এ ধরনের উপকরণের সাহায্য নিয়ে ক্যামেরাকে স্থির রাখা হয়। তবে কখনো কখনো দৃশ্যের প্রয়োজনে ইচ্ছে করেই ক্যামেরাকে নড়তে বা ঝাঁকুনি খেতে দেওয়া হয়; এই কৌশল হলো জার্ক। যেমন : কারো দৌঁড়ে যাওয়া বা সড়কে কয়েকজনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া কিংবা হাতাহাতির দৃশ্য দেখানোর সময় ইচ্ছে করে ক্যামেরাকে জার্ক করানো হয় (জার্ক শট বা জার্কি শট)। এতে দর্শকের মধ্যে ওই দৃশ্যটি আরো বাস্তব বা জীবন্ত হয়ে ওঠে।

১০. পয়েন্ট অব ভিউ (Point of View/POV) : কোনো দৃশ্যে একটি চরিত্রকে পর্দায় দেখানোর পর ওই চরিত্রের চোখে দৃশ্যটি দেখতে কেমন বা ওই চরিত্র তার চোখ দিয়ে তখন কী ও কীভাবে দেখছে, তা যখন ক্যামেরার মাধ্যমে দেখানো হয়, তখন সেটি হলো পয়েন্ট অব ভিউ। এমন কৌশল ব্যবহার করতে অনেক সময় একটি চরিত্রের হাতে বা তার গায়ের সাথে ক্যামেরা যুক্ত করে দিয়ে দৃশ্যটি ধারণ করা হয় এবং এ সময় ওই চরিত্র পর্দায় অনুপস্থিত থাকে। ওই চরিত্রকে সরাসরি দেখতে না পেলেও দর্শক তখন ওই চরিত্রের চোখেই দৃশ্যটি দেখে এবং এতে দর্শকেরা ওই চরিত্রের মতো করে তার পরিপ্রেক্ষিত থেকে দৃশ্যটি দেখতে পায়। তাই এ সময় ওই চরিত্র পর্দায় অনুপস্থিত থাকলেও দর্শক ঠিক বুঝতে পারে, ওই চরিত্রের চোখেই দর্শক সবকিছু দেখছে। এই কৌশল ব্যবহার করে অনেক সময় একটি দৃশ্যকে দর্শকের অনুভূতিতে আরো বাস্তব করে তোলার চেষ্টা করা হয়।

এসব কৌশলের সুনির্দিষ্ট ব্যবহার রয়েছে বা এসব কৌশল ব্যবহারের নির্দিষ্ট কারণ রয়েছে। এ ধরনের কৌশল ব্যবহার করে নির্দিষ্ট কিছু দ্যোতনা তৈরি করা যায়। তবে মনে রাখতে হবে, ক্যামেরার কাজ হলো খুবই সৃষ্টিশীল কাজ। আর যে-কোনো সৃষ্টিশীল কাজেই নিজের মতো করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার অবারিত সুযোগ রয়েছে। তাই একেবারে এসব ছকে বাঁধা না থেকে নিজের মতো করে এসব কৌশল প্রয়োগ করে দেখতে কোনো বাধা নেই।