Media School

Dhaka    Saturday, 20 April 2024

By নুসরাত জাহান

চীন-ভারত সীমান্ত সংঘাত

Media School July 15, 2020

বিরোধপূর্ণ সীমান্ত এলাকা নিয়ে আবারও উত্তপ্ত চীন ও ভারত। ছবি : বিবিসি।

ভারত-চীনের সীমান্ত প্রায় সাড়ে হাজার কিলোমিটারদীর্ঘ সীমান্তে কাশ্মীরের লাদাখ অরুণাচলের কিছু এলাকা সময় সময় উত্তপ্ত হয়চলতি বছরের মে থেকে চীন-ভারত সীমান্তে আবারও দেশদুটির মধ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দিয়েছেএর মধ্য দিয়ে সীমান্ত নিয়ে দেশদুটির পুরোনো বিরোধ আরও জোরদার হলোকারণ এরইমধ্যে বিতর্কিত বিরোধপূর্ণ লাদাখের প্যাংগং লেক থেকে শুরু করে স্বায়ত্বশাসিত তিব্বত এলাকা এবং সিকিমের সীমানার কাছাকাছি দেশদুটির সেনাবাহিনীর মধ্যে শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটেছেএছাড়া লাদাখের পূর্বাঞ্চলে এলএসি (লাইন অব অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল)-এর কাছেও চীন-ভারত সেনাবাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে১৯৬২ সালে সংঘটিত চীন-ভারত যুদ্ধের সময় থেকেই এলাকাগুলো নিয়ে দেশদুটির মধ্যে কখনো কূটনৈতিক পর্যায়ে, কখনও সরাসরি শক্তি প্রদর্শনের ঘটনা ঘটে আসছে যার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বর্তমান সংঘর্ষের ঘটনা

চলতি বছরের মে মাস থেকে গালওয়ান নদীর উপত্যকায় ভারত রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করে।  ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১৫ ১৬ জুন দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলির জের ধরে উভয়পক্ষের একজন করে অফিসারসহ ভারতীয় সেনাবাহিনীর ২০ এবং চীনা বাহিনীর ৪৩ সেনাসদস্য নিহত হনআর এর সবই হয়েছে দুই পক্ষের হতাহাতি, রডের ব্যবহার পাথর ছোঁড়াছুড়ির কারণেএছাড়াও ভারতের সেনা কর্মকর্তাসহ ১০ সেনাসদস্যকে আটকে রাখা হয় বলেও প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়তবে ১৮ জুন চীন তাদের মুক্তি দেয়

ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘এটা সত্যি যে চীনের সেনাবাহিনী এখন আমাদের সীমান্তে অবস্থান করছেতারা, এটা তাদের ভূ-খণ্ড বলে দাবি করছেকিন্তু আমাদের দাবি এটা আমাদের এলাকাফলে এটা নিয়ে দুপক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিয়েছেএখন আমাদের যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করবো।’ নেটওয়ার্ক১৮কে দেয়া এক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কথা জানায়তবে চীনা বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছিলো কিনা, ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি

এদিকে প্যাংগং লেকের ধার ঘেঁষে ফিঙ্গার থেকে পর্যন্ত চীনের বেশ কিছু স্থায়ী অস্থায়ী অবকাঠামো তৈরির ঘটনাকে কেন্দ্র করেই ভারতের আপত্তি থেকে বিবাদ সংঘর্ষের সূত্রপাত বলে জানা যায়- যদিও চীনের পক্ষ থেকে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়নিতবে ফ্রান্সের কাছ থেকে ভারতের রাফায়েল যুদ্ধবিমান কিনে সীমান্ত এলাকায়  মোতায়েন একইসময় চীনেরও ট্যাঙ্কের বহর বাড়ানো উভয় পক্ষের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতিরই আভাস অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে গত জুন দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হলেও ১৫ জুনের হতাহতের ঘটনার পর তা ভেস্তে যায়পরে ২৩ জুন আবারও আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যে পৌঁছে দুই দেশ এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে এলএসি বরাবর চীন বাঙ্কারসহ স্থায়ী কাঠামো তৈরি বন্ধে নীতিগতভাবে রাজি হয় বলে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাতে ফ্রান্সের বার্তা সংস্থা এএফপি' খবরে জানা যায়তবে নিরাপত্তার স্বার্থে ভারত নিজ দেশে ৫৯টি চীনা অ্যাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেএকইসঙ্গে নির্মাণ কাজ থেকে সরে না গিয়ে বরং তা আরও ত্বরান্বিত করতে ভারতের 'বর্ডার রোড অরগানাইজেশন' সেখানে আরও ১২ হাজার অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করে বলেও জানা গেছে

১৯৬২ সালে সীমান্ত নিয়ে চীন ভারতের মধ্যে সংঘটিত সংক্ষিপ্ত তবে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের পর থেকে পর্যন্ত সেখানে দুদেশের সেনা উপস্থিতি থাকলেও সাম্প্রতিক ঘটনার আগ পর্যন্ত কোনো বিবাদ হয়নিএমনকি ১৯৭৬ সাল থেকে কোনো গুলিও চলেনিসেনাদের মধ্যে বছরে অনন্ত চারশোটি অস্বস্তিকর ঘটনা ঘটলেও দ্রুত তার কূটনৈতিক সমাধান করা হয়কিন্তু এবার ব্যতিক্রমভাবে এমনকি চীন যে অংশকে ভারতের বলে স্বীকার করে, সেখানে শুধু প্রবেশই করেনি বরং স্থায়ী উপস্থিতি জানান দিতে পেনোং সো লেকের কাছের ভারতীয় ভূ-খণ্ডে তাঁবু, কংক্রিটের স্থাপনা এমনকি কয়েক মাইলজুড়ে রাস্তাও নির্মাণ শুরু করে

অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে এলএসি বরাবর বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করে চলেছে ভারতলাদাখের রাজধানী লেহ্ থেকে দৌলত বেগ ওলডি বায়ু সেনাঘাঁটি পর্যন্ত দেশটির নির্মিত ২৫৫ কিলোমিটার রাস্তা চীনের জন্য দুঃশ্চিন্তার বিষয়কারণ এএলসি বরাবর তা ভারতকে অনেক সুবিধাজনক অবস্থানে রেখেছেফলে অঞ্চলে কোনো অবকাঠামো নির্মাণে বরাবরই ভারতকে বাধা দিয়ে আসছে চীন, যা তাদের সামরিক কৌশলেরই অংশসম্প্রতি নেপালের সঙ্গেও ভারতের সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছেএক্ষেত্রে নেপালকে চীন মদদ দিচ্ছে বলে ভারতের নীতিনির্ধারকদের একাংশের ধারণা

আবার পাকিস্তানের অধীন কাশ্মীর অংশে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে চীনের রাস্তা যাবে, নিয়ে অঞ্চলে উত্তেজনা ছড়াতে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে ভারতকে চাপে রাখতে চায় চীনএকইসঙ্গে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় অরুণাচলকে নিজেদের বলে দাবি, এমনকি তাদক্ষিণ তিব্বতনামকরণের মধ্য দিয়ে প্রকৃতপক্ষে ভারতসহ অঞ্চলে দেশটির মিত্র অন্যান্য ছোট দেশকে চাপে রাখার এটা চীনা কৌশল বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা

এক্ষেত্রে চীন ছোট ছোট দলে সেনা প্রবেশ করিয়ে ভারতের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে এবং ভারতীয় ভূ-খণ্ডের কয়েক কিলোমিটার এলাকা মুক্ত ঘোষণা করে শান্তির ঘোষণা দেবে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণাকারণ এটা তাদের পুরোনো কৌশলঅন্যদিকে ভারতের পক্ষে চীনাদের বিপক্ষে যাওয়ার যেমন ক্ষমতা নেই, তেমনি হেরে গেলে বর্তমান সরকার জনগণের সমর্থন হারাবেচীন এক্ষেত্রে ভারতের স্থাপনা রাস্তাঘাট নির্মাণকে উস্কানিমূলক বললেও চীনই বরং বহু আগেই এলএসির তাদের অংশে চলাচলের জন্য উন্নত রাস্তাঘাট, স্থাপনা, রেল এমনিক বিমানবন্দরও নির্মাণ করেছে, যার বিপরীতে ভারতের ধরনের তেমন কোনো স্থাপনা বা অবকাঠামো নেই বললেই চলে অবস্থায় চীনের আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি রাশিয়াও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে

গার্ডিয়ানের বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের 'ইন্ডিয়া প্রজেক্ট'-এর পরিচালক তানভি মাদান বলেন, ' ধরনের এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিনব্যাপারটা এমন নয় যে এমন ঘটনা শুধু তাৎক্ষণিকভাবে ঘটেছেএটা নিয়ে চীনের ঊর্ধ্বতন মহল থেকে নির্দেশনা এসেছে।'

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি)-এর নিরাপত্তা অধ্যয়নের অধ্যাপক ভিপিন নারাংয়ের মতে, ভারতের গণমাধ্যম তুলনামূলক স্বাধীন অবস্থায় জাতীয়তাবাদীদের দিক থেকে এক ধরনের চাপ আছে প্রতিশোধ নেয়ার বিষয়েফলে খুব সহজে এই উত্তেজনা কমিয়ে আনা কঠিন হবে ভারতের জন্য

অন্য বিশ্লেষকদের মতে, সীমান্তে চীনের সেনা জমায়েতের অন্যমত প্রধান দুটি কারণ : প্রথমত, তিব্বতকে পুরোপুরি দখলে নেয়া এবং এখানে ভারতের স্থাপনা নির্মাণ পুরোপুরি থামিয়ে দেয়াদ্বিতীয়ত, বৌদ্ধদের দালাইলামা কে হবেন, তা নিয়ে ভারতের হস্তক্ষেপ অযাচিত বলে চীনের কর্মকর্তারা মনে করেন- যদিও বর্তমান দালাইলামা ভারতভিত্তিক বর্তমানে ভারতেই অবস্থান করছেনতা ছাড়া তিব্বতের স্বাধীনতাকামী প্রবাসী সরকারও ভারত থেকে পরিচালিতএটি চীনের জন্য অসুবিধার কারণ

অন্যদিকে করোনাভাইরাস চীন থেকে কীভাবে ছড়ালো, তা অনুসন্ধানে যে সংস্থাগুলো ডব্লিউএইচও-কে চাপ দিচ্ছে, তার মধ্যে ভারতও রয়েছেবর্তমান পরিস্থিতিতে ঘটনাকে অনেকে অপ্রাসঙ্গিক মনে করলেও ভাইরাস নিয়ে চীনের যে বিশ্বব্যাপী সমালোচনা, তা থেকে মনোযোগ সরানোও তাদের একটি কৌশল অবস্থায় চীনা আগ্রাসন রুখতে ভারতকে বিরোধীদের আস্থায় এনে জাতীয় ঐক্যের ভিত্তিতে এর মোকাবেলা করতে হবে বলে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইংস বা’-এর সাবেক স্পেশাল সেক্রেটারি অমিতাভ মাথুরের মত

অবস্থায় পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত ত্রিমুখী কৌশল নিয়েছে : প্রথমত, সামরিক কূটনৈতিক স্তরে আলোচনার মধ্য দিয়ে স্থিতাবস্থা ফেরানো; দ্বিতীয়ত, কূটনৈতিক পর্যায়ে বৈশ্বিক জনমত ভারতের পক্ষে চীনের বিপক্ষে নেয়া; এবং তৃতীয়ত, ভারতীয় অর্থনীতির অতিরিক্ত চীন-নির্ভরতা কমানোএর অংশ হিসেবে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে চীনা পণ্য বর্জনের পক্ষে আন্দোলন শুরু হয়েছেঅনেক ভারতীয় এমনকি বিখ্যাতরা ব্যক্তিরাও এর সমর্থন করলেও বিশ্লেষকদের মতে এতে ক্ষতি বরং ভারতেরই বেশিকারণ যে কম দামে মানসম্পন্ন পণ্য তারা চীন থেকে পায়, তা অন্য দেশ থেকে পেতে অনেক খরচ করতে হবেতাছাড়া দেশদুটির মধ্যে যে বিশাল বাণিজ্য সম্পর্ক, সেখানে ভারতের রপ্তানির তুলনায় আমদানিই বেশি এবং দেশটির বাজার চীনা পণ্যনির্ভরহঠাৎ করে তা বন্ধ করলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের বিপদ দেখা দেবেকরোনার কারণে এমনিতেই অর্থনীতি বিপর্যস্তগত মে মাসে দেশটির রপ্তানি কমেছে ৩৬ দশমিক শতাংশ আর বছর আমদানি বেড়েছে ৫১ দশমিক শতাংশ অবস্থায় চীনা পণ্য বর্জনের ডাক চীন নয় বরং ভারতের জন্যই বিপদের কারণ হয়ে দেখা দেবে

অন্যদিকে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চীনকে টপকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের চেষ্টা করলেও বর্তমানে চীন ইস্যুতে কেউই দেশটির পাশে নেইযদিও সম্পর্কোন্নয়নের ফলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপের দেশগুলো চীন থেকে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে তা ভারতে লগ্নি করবে বলেই মোদী ভেবেছিলেন, কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে তাঁর চিন্তা এখন ভুল বলেই প্রতীয়মান হচ্ছেকারণ যুক্তরাষ্ট্র এখন যেমন এক চীন নীতির বিরোধিতা করছে না, তেমনি দেশটির সরকার বদলেরও কোনো ইচ্ছা তাদের নেইবিশিষ্ট এশিয়া বিশেষজ্ঞ স্টিফেন রোসের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রে অচিরেই বড় আকারের বাজেট ঘাটতি এবং এর ফলে ডলারের মূল্যপতন শুরু হবে কারণে দেশটি এখন চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সমঝোতায় যেতে চায়আগামী নির্বাচনের পরই ধরনের চুক্তি হতে পারেযদিও মোদি আশা করেছিলেন করোনা-পরবর্তী সময়ে দেশগুলো চীন নয় বরং ভারতের সঙ্গেই বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়বে, কিন্তু তা হচ্ছে না।’

অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ্ব অঞ্চলে এলে ভারত মহাসাগর জটিলতা চীনের জন্য আরও বাড়বেএসব কারণে ভারতকে চাপে রাখতে চীনের কৌশল বলেও ধারণা করা হচ্ছেফলে সংঘাত নয় বরং আলোচনা দিয়ে সংকট কাটিয়ে ওঠাই ভারতের জন্য এখন একমাত্র উপায় বলেই নেপালের ত্রিভূবন ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কূটনীতি বিষয়ের অধ্যাপক ভিম বুরতেল এশিয়া টাইমসকে জানিয়েছেনতবে, সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তেজনা প্রশমনে দুপক্ষের সঙ্গেই আলোচনা করে সমস্যা সমাধানের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন বলে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাবেক সামরিক কর্মকর্তা . এম সাখাওয়াত হোসেন কৌশলগত ভূ-কৌশলগত - দুটি দিক থেকে ঘটনাটি বিশ্লেষণ করেছেনতাঁর মতে, ভারত গত প্রায় দুই বছর ধরে ২৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি পাকা রাস্তা গালওয়ান সায়খ নদের পশ্চিম তীর ঘেঁষে তৈরি করেছেদৌলত বেগ ওলি নামক এই রাস্তা প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ ফুট ওপরে দোই উপত্যকায় স্থাপিত বিমানঘাঁটিকে যুক্ত করেছেচীন বিমানঘাঁটি এবং সেখানে সৈন্য সমাবেশসহ রাস্তা অন্যান্য সামরিক অবকাঠামো নির্মাণে আপত্তি জানিয়েছেকিন্তু ভারত আপত্তি মানেনিচীনের দাবি, রাস্তা এলএসির খুব কাছে এবং দৌলত বেগ স্থাপনা চীনের সীমান্তের কাছাকাছিএছাড়া ভারত গালওয়ান উপত্যকার সায়খ নদে পুল নির্মাণের উদ্যোগ নিলে উত্তেজনা শুরু হয়একপর্যায়ে উভয় পক্ষের মধ্যে হাতাহাতি হয়পরে উত্তেজনা প্রশমনের কথা থাকলেও চীন সরে আসেনিচীন ওই অঞ্চল দখলে রেখেছেতার মানে, চীন দৌলত বেগের রাস্তা যে-কোনো সময় ছিন্ন করতে পারে

অন্যদিকে, অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলেও . সাখাওয়াত হোসেন মনে করেনএক্ষেত্রে ভারতের সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং কাশ্মীর লাদাখ অঞ্চলকে আলাদা করে ইউনিয়ন টেরিটরি ঘোষণার ঘটনাটিসহ ভারতের যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র ইসরায়েলের দিকে ঝুঁকে পড়া, ২০১৯ সালে বিরোধপূর্ণ দক্ষিণ চীন সাগরে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ফিলিপাইনের সাথে ভারতের সম্মিলিত নৌ মহড়া, গত কয়েক বছর ধরে ভারতের উত্তরাঞ্চলের বিমানঘাঁটিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেশটির যৌথ মহড়া এবং কয়েক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের মিউচুয়াল লজিস্টিক সাপোর্ট এগ্রিমেন্ট (যার আওতায় দুই দেশ বিভিন্ন সামরিক কারণে উভয় দেশের নৌবাহিনীর ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবে) এবং সর্বোপরি করোনাভাইরাস ছড়ানোর দায়ে চীনকে দোষী সাব্যস্ত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের সুর মেলানো - মূলত এসব কারণেই আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মধ্যে পড়ে ভূ-রাজনৈতিকভাবে চীন ভারতকে ঘিরে ফেলেছেকূটনৈতিকভাবে এর সমাধান মানে চীনের দখলে ভূমি থেকে যাওয়া, যা বর্তমান ভারত সরকারের জন্য হবে এক বিরাট ব্যর্থতাঅন্যদিকে বাণিজ্য অর্থনীতির ক্ষেত্রে যেভাবে চীনা পণ্য বর্জনের ডাক আসছে, তা ভারতের অর্থনীতিকে যে চাপে ফেলবে, বর্তমান করোনা মহামারির সময় দেশটির পক্ষে চাপ সামলানো সম্ভব নয়শেষ পথ সামরিক শক্তি প্রয়োগএটা হলে চীন আরও সুযোগ পাবে ভারতের পূর্বাঞ্চলেও তৎপরতা চালাবে এবং ১৯৬২ সালের মতো এবার আর সরে আসবে নাএক্ষেত্রে নেপাল পাকিস্তানও জড়িয়ে পড়তে পারে এবং উপমহাদেশ হয়ে উঠবে পুরোপুরি অস্থিতিশীল

অতএব, বর্তমান পরিস্থিতি কি বিবদমান দুপক্ষই মীমাংসা করবে নাকি তা আরও দূর গড়াবে - প্রসঙ্গে ভারতের বেঙ্গালুুরুভিত্তিক তক্ষশীলা ইনস্টিটিউটের চীন অধ্যয়ন বিষয়ের ফেলো মনোজ কিওয়ালরামানি আল-জাজিরাকে বলেন, ‘অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে পুরো বিষয়টিই চীন কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে, ফলে ইস্যুতে তারা এমনকিছু করবে না যাতে তাদের অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েএমনকি তা এরইমধ্যে অস্থিতিশীল হয়ে পড়া দক্ষিণ চীন সাগর হংকং ইস্যুতেও প্রভাব ফেলবে বলেই ধারণা করা যায়।’

তবে সর্বশেষ খবর হচ্ছে, অবশেষে গালওয়ানসহ লাদাখের অন্যান্য এলাকায় মুখোমুখি অবস্থান থেকে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছে চীন ভারতদুই পক্ষের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের আলোচনার পর উভয় পক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়গালওয়ান উপত্যকা থেকে চীন জুলাই প্রায় দুই কিলোমিটার পিছিয়ে যায় এবং এলএসি বরাবর একটি বাফার জোন তৈরি করেতবে সমাঝোতা সত্বেও প্যাংগং লেক থেকে চীন এখনও সরেনি- যদিও জুলাইয়ের মাঝামাঝি দেশটি সব জায়গা থেকেই সরে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছেঅন্যদিকে, সেনা সরে যাওয়ার মধ্য দিয়ে উত্তেজনা কিছুটা কমে এলেও ভারত এখনও সেনা টহল জোরদার রাখাসহ লাদাখে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান হেলিকপ্টার মোতায়েন রেখেছে

তবে চীনের পক্ষ থেকে সংঘর্ষ নয় বরং সমঝোতার পরিবেশ তৈরির প্রচেষ্টার কথা জানানো হচ্ছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছেভারতে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক এক বিবৃতিতে দুই দেশকে একে অন্যের প্রতিপক্ষ নয় বরং সহযোগী ভাবার আহ্বান জানানো হয়েছেএতো রক্তক্ষয়ের পর শুধু নরমই নয় বরং যথেষ্ট সমীহ উদ্রেককারী বিবৃতির মূল উদ্দেশ্য বের করা নিয়েই এখন ব্যস্ত ভারত! দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্র অনুযায়ী, এমনিতেই করোনা পরিস্থিতি নিয়ে বিশ্বে চাপে রয়েছে চীন অবস্থায় ভারত চীনবিরোধী আন্তর্জাতিক জোটের মাধ্যমে দেশটিকে যেন আর চাপের মধ্যে না ফেলে, এজন্য আগেভাগেই তারা সমঝোতার পথে হাঁটছেতবে একইসঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেন না যায়, এজন্য দেশটি কৌশলে নেপাল ভুটানের মাধ্যমে ভারতকে চাপেও রাখছে

এদিকে গত জুলাই চীনকে কড়া বার্তা দিতে এবং একইসঙ্গে নিজ দেশের সেনাদের মনোবল জোগাতে আকস্মিকভাবে লাদাখ ভ্রমণে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিমূলত চীনের ক্রমাগত স্থাপনা বাড়িয়ে চলা নিয়ে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ শক্তি প্রদর্শনই এর মূল উদ্দেশ্য বলে ধারণা করা হয়তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন তাদের সুর নরম করলেও ভারত এখনও তার পূর্বের সতর্ক অবস্থা থেকে সরে আসেনি, বরং পুরো পরিস্থিতির ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখছেঅতএব, দুপক্ষের পাল্টাপাল্টি অবস্থা অবস্থান শেষ পর্যন্ত কোথায় গড়ায়, এখন এটাই দেখার বিষয়!

নুসরাত জাহান : লেখক ও গবেষক।