Media School

Dhaka    Saturday, 20 April 2024

By নুসরাত জাহান

জয়িতার একদিন

Media School October 19, 2020

প্রতীকী ছবি।

‘লৈঙ্গিক সমতা’! এক সকালে আধো ঘুম চোখে শুয়ে হঠাৎ এ শব্দদ্বয় মনে পড়ে হাসি পেলো জয়িতার; যদিও হাসির কারণ সম্পর্কে সে পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। তবে মনে হচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবা যায়। কারণ, বর্তমানে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ পার্থক্যকারী শব্দগুলো ব্যবহার না করে বরং নিরপেক্ষ শব্দ ব্যবহারের একটা চল দেখা যাচ্ছে; যেমন : চেয়ারপারসন, ক্যামেরাপারসন, শিক্ষার্থী ইত্যাদি। কিন্তু, মজার ব্যাপার হলো, মানুষের মানসিক ভীত গঠনের জায়গা অর্থাৎ স্কুলের বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে ‘লিঙ্গ পরিবর্তন’ নামের অদ্ভুত অধ্যায়টি এখনও রয়ে গেছে। শিক্ষক-মহিলা শিক্ষক, ঘোড়া-মাদী ঘোড়া... কি অদ্ভুত!

এসব ভেবেই কি হাসি পেলো জয়িতার? নাকি আধো ঘুম চোখ আর শরীরের প্রচণ্ড অস্বস্তি নিয়ে শুক্রবারের আরামের ঘুমটা ছেড়ে এখন বাধ্যতামূলকভাবে উঠতে হবে বলে মাথাটা বিগড়ে আছে? কে জানে! মাঝে মাঝে নিজেকেই বুঝতে পারে না সে। আর, বলাই তো হয়ে থাকে, ‘নারী, সে বড় রহস্যময়!’ ‘নারী’, ‘মহিলা’ নয় কিন্তু; মনে হয়ে আবারও হাসি পেলো তার! নাহ্! এসবে চিড়ে ভিজবে না, উঠতেই হবে এখন।

২০১৮ সালে ‘হ্যাশট্যাগমিটু’ আন্দোলন বড় চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো। কী এই আন্দোলন? কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রতি যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ভাবা যায়? আসলেই ভাবা যায় না। একবিংশ শতাব্দিতে এসেও.... দূর! ক্ষিদেয় পেট মোচড় দিচ্ছে, কী হবে এসব ভেবে? উদরপূর্তি করাটা জরুরি। হুম, উদরপূর্তি। একজন নারীর পেটের ক্ষুধা মেটাতে হলে তার নিজেরটা নিজের করে খেতে হবে - তা নিজে রেঁধে হোক বা অন্যকে দিয়ে রাঁধিয়ে হোক। অন্যকে দিয়ে রান্নার কাজটা করালেও তদারকি তো করতে হয় ওই নারীকেই; তা সে গৃহিণীই হোক বা কর্মজীবী। ‘ঘরে থাকা নারী’ যদিও সারা দিন ‘কিছুই করে না’ বলে একরকমের প্রতিষ্ঠিত অপবাদের শিকার, তেমনি ঘরের বাইরে কাজ করে বলে কি কর্মজীবী নারীর জীবন হয়রানিমুক্ত? ঘরের নানা হ্যাপা সামলে যখন কর্মক্ষেত্রে শামিল হয়, তখন কেবল ‘নারী’ হওয়ার ‘অপরাধে’ তাকে যে কতো রকমের হেনস্তার শিকার হতে হয়, তার প্রতিফলনই বুঝি বিশ্বজুড়ে ঝড় উঠানো এই আন্দোলন! আর, যে নারী কাজে যায় না, বাড়িতেই থাকে, তার অবস্থা? শুধু কি কিছু না করার অপবাদ? আবারও হাসি পাচ্ছে জয়িতার। এবার কি বেশি ক্ষুধার কারণে? কে জানে! তবে যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, খাবারটা তৈরি করে ফেলাই ভালো, যদিও আজ কাজে যাওয়ার তাড়া নেই; ছুটির দিন কি না!

রান্না করতে করতেই ভাবছিলো জয়িতা- আজ, এখনও, এই যুগে এসেও এমন হয় যে, নারীর সাথে পুরুষেরা কথা বলতে চায় না! এমন না যে, তাদের কথা বলতে ভালো লাগে না, বরং এর উল্টোটাই। কিন্তু, যখন কোনো ‘কাজের’ কথা হয়, তখন একজন পুরুষকেই খোঁজা হয়; ‘মহিলা মানুষ আর কী বোঝে’ - মনোভাবটা সব সময় এমনই। আর যেসব নারী সমাজের বড় পদে থাকে আর তার অধীনে থাকে অনেক ‘পুরুষ’, সেই নারীদের সংগ্রামটা হয় আরও অনেক বেশি কঠিন। মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছে, তরকারিতে ঝাল পড়ে যাচ্ছে বেশি, ধ্যাৎ!

কত মানুষের বাস একটা শহরে? উদরপূর্তির পর এক কাপ গরম চা হাতে আয়েশ করতে করতে ভাবে জয়িতা। একজন অপরিচিত মানুষ বা একটি পরিবারের সাথে একবারের বেশি কি দেখা হয় কখনো? নাকি মনে রাখতে পারি না? মনে রাখার ক্ষমতা যে মানুষের নেই, তা কি? মানুষ তো অসীম ক্ষমতার অধিকারী, গঠনগতভাবেই। কিন্তু আসলে নিজেকে নিয়ে মানুষ এতোই ব্যস্ত যে... আর না থেকেই বা কী করবে? স্বার্থপরের এই দুনিয়ায় স্বার্থান্বেষী না হয়ে উপায়ই বা কী? নাহ্! আজ দিনটাই যেন কেমন, চা-টা জুড়িয়ে যাচ্ছে...

সারা দিনের ঝড়ঝাপটা আর উদ্ভট সব চিন্তা শেষে আরও একটা দিন শেষ করতে যাচ্ছে জয়িতা। তবে দিনটা যদিও শুরু হয়েছিলো হাসির মধ্য দিয়ে, কিন্তু শেষ হতে যাচ্ছে মন খারাপ দিয়ে; তীব্র মন খারাপ। কেন সবকিছু এমন, সবাই কেন এমন, কেন সে নিজেই বা এমন... উফ্! বুকটা এতো ব্যথা করে! ‘ভালোবাসার ডালি নিয়ে তুমি বসে আছো আর এ ভালোবাসার তীব্রতা বুঝে তেমনি করে ভালোবাসার ক্ষমতা তো দূর, এর বোধটুকুও হয়তো সারা দুনিয়ার কোনো পুরুষের নেই’ - নারী ও পুরুষের মধ্যে ভালোবাসার অনুভূতি ও তা প্রকাশের প্রতিটি কৌশল যে কতো ভিন্ন, এটাই কি সমাজের সব সমস্যার মূল? তীব্র বেদনাদায়ক এ পার্থক্যের ফসলই কি মানবজাতি? এটাই কি ভেদাভেদ করে দিয়েছে নারী-পুরুষেতে?...

লৈঙ্গিক অসমতা!

নুসরাত জাহান : কলামিস্ট ও গবেষক।