Media School

Dhaka    Saturday, 27 April 2024

By রাজীব সরকার

দুই চিকিৎসকের দ্বন্দ্ব ও রবীন্দ্রনাথের অস্ত্রোপচার

Media School August 16, 2021

মৃত্যুর আগে শান্তিনিকেতন ছেড়ে গাড়িতে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (জুলাই ১৯৪১)। ছবি : বিনোদ কোঠারি।

‘বেলা নয়টায় দেওয়া হলো অক্সিজেন। শেষবারের মতো দেখে গেলেন বিধান রায় ও ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। কানের কাছে অবিরাম পড়া হচ্ছিল তাঁর জীবনের বীজমন্ত্র ‌‌‌‘শান্তম, শিবম, অদ্বৈত্যম’। খুলে দেওয়া হলো অক্সিজেনের নল। ধীরে ধীরে কমে এল পায়ের উষ্ণতা, তারপরে একসময়ে থেমে গেল হৃদয়ের স্পন্দন। ঘড়িতে তখন ১২টা ১০ মিনিট।’

এভাবেই বাইশে শ্রাবণের দৃশ্যকল্প রচিত হয়েছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, রানী চন্দ, প্রতিমা দেবী, নির্মলকুমারী মহলানবিশসহ নানাজনের লেখা ও স্মৃতিচারণা থেকে রবীন্দ্রনাথের জীবনের শেষ দিনগুলোর মর্মস্পর্শী বিবরণ পাওয়া যায়।

১৯৩৭ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিখ্যাত চিকিৎসকেরা তাঁর চিকিৎসা শুরু করেন। অসুস্থ শরীরেও কবির ক্লান্তি নেই। তিনি লিখে চলেছেন। চিকিৎসকদের বিদ্রূপ করে বলেছেন, ‘রোগী আছে রোগ নেই, ওরা চিকিৎসা করবে কার? এতে ওদের মন খারাপ হয় না।’ ভগ্ন স্বাস্থ্যেও রবীন্দ্রনাথের তীক্ষ্ণ রসবোধ লক্ষ করার মতো।

১৯৪০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর শান্তিনিকেতন থেকে পূত্রবধূ প্রতিমা দেবীর কাছে গিয়েছিলেন দার্জিলিং পাহাড়ের কালিম্পঙে। সেখানেই ২৬ তারিখ রাতে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন কবি। প্রতিমা দেবী সেখানে একা। প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ কলকাতা থেকে চিকিৎসক নিয়ে গেলেন। কবিকে কলকাতায় আনা হলো অজ্ঞান অবস্থায়। এক মাস শয্যাশায়ী রইলেন। শুয়ে শুয়ে কবিতা বলেন, অন্য কেউ লিখে নেয়। এই কবিতাগুলো রোগশয্যায় কাব্যগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। আরোগ্য ও জন্মদিনে কাব্যগ্রন্থও কবির জীবনের শেষ বছরে রচিত।

১৮ নভেম্বর শান্তিনিকেতনে ফিরলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী আট মাস সেখানে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ছিলেন। কখনো চেয়ারে, কখনো বিছানায় তাঁর দিন যায়। রাত যায় অনিদ্রায় ও বিচিত্র ভাবনায়। এর মধ্যেও তাঁর সৃষ্টিধারা প্রবহমান। রবিঠাকুরের কয়েকটি অসামান্য কবিতা এ সময়ে লেখা। যেমন ‘ঐকতান’ কবিতায় বলেছেন, ‘বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।’ আবার জীবনসায়াহ্নে অনুভব করেছেন, ‘আমার কবিতা, জানি আমি,/ গেলেও বিচিত্র পথে হয় নাই সে সর্বত্রগামী।’

প্রস্টেট গ্ল্যান্ডের সমস্যায় প্রচণ্ড কষ্ট পাচ্ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর চিকিৎসা নিয়ে দুই প্রজন্মের চিকিৎসকদের দ্বন্দ্বের আভাস পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখা ও বক্তব্যে। রানী চন্দের গুরুদেব বইটিতে উল্লেখ রয়েছে যে কবিকে বলা হয়েছিল ছোট্ট একটা অস্ত্রোপচার; এটা করিয়ে নিলেই তাঁর আচ্ছন্নভাবটা ঠিক হয়ে যাবে, পরের দশ বছর আবার আগের মতোই লিখতে পারবেন। তবে ১৯১৬ সাল থেকে রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসা করছিলেন যে কিংবদন্তি চিকিৎসক নীলরতন সরকার, তিনি কখনোই কবির অস্ত্রোপচার করানোর পক্ষে ছিলেন না। ডা. সরকার যখন স্ত্রী বিয়োগের পরে গিরিডিতে চলে যান, সেই সময়ে আরেক বিখ্যাত চিকিৎসক বিধান চন্দ্র রায় শান্তিনিকেতনে গিয়ে অস্ত্রোপচার করার কথা জানিয়ে দেন।

তাঁদের সবার যুক্তিতর্ক শুনে স্যার নীলরতন বললেন, ‘আপনাদের কথা সবই ঠিক যে এ অপারেশন খুবই সহজ। অনেকবার অনেক বৃদ্ধের রোগ আপনারা সারিয়েছেন, সামান্য একটা ফোঁড়া কাটার মতো ব্যাপার। সবই মানলাম কিন্তু আপনারা একটা কথা মনে রাখছেন না যে রোগী অন্য কোনো লোক নয়, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। সর্বসাধারণের মতো ওর নার্ভাস সিস্টেম নয়। সুকুমার দেহ ওর। কাজেই অন্য লোকের সঙ্গে তুলনা করা চলে না। খুব ভালো করে সুরে বাঁধা একটা বাদ্যযন্ত্রের মতো। বাইরে থেকে আঘাত করতে গেলে যে ধাক্কা শরীরে লাগবে, তাতে ওর সমস্ত দেহ যন্ত্রটাই বিকল হয়ে যাবার আশঙ্কা। আমার মনে হয় না এই রিস্ক নেওয়া উচিত হবে। ওষুধ দিয়েই এখন চিকিৎসা হোক না।’ কবির পুত্র রথীন্দ্রনাথসহ অন্য শুভাকাঙ্ক্ষীরা স্যার নীলরতনের কথায় স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।

এ ঘটনার পর কেটে যায় এক বছর। রবীন্দ্রনাথের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। এ অবস্থার মধ্যেও থেমে থাকেনি তাঁর হাসিঠাট্টা, চিঠি লেখা, সাহিত্যচর্চা। কবির পথ্যের মধ্যে বরাদ্দ ছিল শুধু চালকুমড়া। শিশুর মতো জেদ করে তিনি বাদ দিচ্ছিলেন এসব খাওয়া। এর মধ্যেই খবরের কাগজ পড়ে ছটফট করেছেন। রাশিয়ার অগ্রযাত্রায় খুশি হচ্ছেন, হিটলারের জয়ের সংবাদে মুষড়ে পড়েছেন। তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পাওয়ায় অস্ত্রোপচারের পক্ষে মতামত প্রবল হতে থাকে।

রবীন্দ্রনাথ অস্ত্রোপচার করাতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন আগের চিকিৎসাই বহাল রাখতে। কবিরাজ বিমলানন্দকে তিনি বলেছিলেন, ‘দেখো হে তোমরা আমার কিছু করতে পারো কি না। ছেলেবেলা থেকে আমার শরীরে কোনো অস্ত্রাঘাত হয়নি, শেষকালে কি যাবার সময় আমাকে ছেঁড়াখোঁড়া করে দেবে?’ রবীন্দ্রনাথ নির্মল কুমারীকে বলছিলেন, ‘দেখো রানী, আমি কবি আমি সুন্দরের উপাসক। বিধাতা আমার এই দেহখানা সুন্দর করে গড়েছিলেন। এখান থেকে বিদায় নেবার সময়, এই দেহখানা তেমনি সুন্দর অবস্থাতেই তাকে ফিরিয়ে দিতে চাই। গাছ থেকে শুকনো পাতা যেমন আপনি ঝরে যায়, পক্ব সুপারি ফল যেমন বৃন্ত থেকে আপনি খসে পড়ে, আমারও ঠিক তেমনিভাবেই সহজে বিদায় নেয়ার ইচ্ছে চিরকাল। কেন এরা যাবার আগে আমাকে ছেঁড়াখোঁড়া করে দিতে চাচ্ছে? বয়স তো ঢের হয়েছে, আর কদিনই মানুষ বাঁচে, কাজেই ছেড়ে দিক না আমাকে। ফুলের মতো ফলের মতো, শুকনো পাতার মতো আমার স্বাভাবিক পরিসমাপ্তি ঘটুক।’

৯ শ্রাবণ (২৫ জুলাই) কবিকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হলো। শান্তিনিকেতনের সঙ্গে রয়েছে তাঁর অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি। তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন এই তাঁর শেষযাত্রা। যাওয়ার আগে আশ্রমের ছোট–বড় সবাইকে দেখতে চাইলেন তিনি। গাড়িতে শুইয়ে তাঁকে ঘোরানো হলো আশ্রম। তখন নতুন আলোর জন্য চারদিকে বসানো হচ্ছিল ল্যাম্পপোস্ট। তাই দেখে বললেন, ‘এখন বুঝি পুরোনো আলো গিয়ে নতুন আলো আসবে।’ আশ্রমের চিকিৎসক শচীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে ইশারায় কাছে ডেকে নিলেন। তাঁর দুটো হাত নিজের হাতে ধরে রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘ডাক্তার, আমার আশ্রম রইল আর আশ্রমবাসীরা রইলেন, তাঁদের তুমি দেখো।’ রবীন্দ্রনাথের চোখে তখন জল। কাঁদছেন শচীন্দ্রনাথও।

৩০ জুলাই জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কবির অস্ত্রোপচার হয়। অস্ত্রোপচারের আগমুহূর্তে তিনি শেষ লেখা রচনা করলেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি/ বিচিত্র ছলনাজালে হে ছলনাময়ী/... অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে/ সে পায় তোমার হাতে শান্তির অক্ষয় অধিকার।’ চিকিৎসকদের দাবি, অস্ত্রোপচার খুব ভালো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ কাঁদতে কাঁদতে বললেন, ‘জ্যোতি মিথ্যে কথা বলেছে। কেন বলেছিল যে কিচ্ছু লাগবে না। আমার খুব লেগেছে—এত কষ্ট হচ্ছিল যে আমি জোর করে ঠোঁট টিপে চোখ বুজে পড়ে রইলুম, পাছে আমার মুখ দিয়ে কোনো আর্তনাদ বেরিয়ে যায়।’

রবীন্দ্রনাথ আর সুস্থ হলেন না। হিক্কা আরম্ভ হলো প্রচণ্ড, কিডনি অকার্যকর হতে শুরু করল। চিকিৎসক, নার্স, শুভানুধ্যায়ী সবাই বিচলিত। অস্ত্রোপচারের পরেই কবির প্রচণ্ড জ্বর আসে। এরপর শুরু হয় হেঁচকি। বিধান রায় এত দিন পর্যন্ত প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাস নিয়ে জোড়াসাঁকোর লোকজনকে নির্বাক করে রেখেছিলেন। কিন্তু হেঁচকি শুরু হতেই তিনি অসহায়ের মতো বাড়ির মেয়েদের বলেন, ‘তোমরা তো অনেক টোটকা জানো। দেখো না যদি গুরুদেবের হেঁচকি বন্ধ করতে পারো।’

অস্ত্রোপচারের পরে ধীরে ধীরে কবি আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন, জ্ঞান নেই তাঁর। সবাই-ই যখন বুঝতে পারছে কী ঘটতে চলেছে, তখনই গিরিডি থেকে খবর দিয়ে আনানো হয় নীলরতন সরকারকে। তিনি এসে নাড়ি দেখলেন, পরম মমতায় কপালে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপরে উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে বেরিয়ে যাওয়ার সময়ে ডা. সরকারের দুচোখে ছিল জল।

একালের চিকিৎসক ও লেখক শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, ‘পেনিসিলিনবিহীন যুগে ওই অস্ত্রোপচারের ফল যে খারাপ হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি ছিল, সেটা একবারও বলা হয়নি কবি বা তাঁর পরিবারকে। ওইভাবে অস্ত্রোপচার করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং ভালো করে না বুঝিয়ে সম্মতি আদায় করাটা মেডিকেল এথিকসবিরোধী।’ জোড়াসাঁকোর একটি বারান্দা জীবাণুমুক্ত করে অস্ত্রোপচার করেন ললিত বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন ওঠে, এভাবে বারান্দায় অস্ত্রোপচার করে তিনি কি ঠিক করেছিলেন? রবীন্দ্রনাথকে কি যথেষ্ট জীবাণুমুক্ত পরিবেশে অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল? পরে ঘনিষ্ঠমহলে বারবার ডা. নীলরতন সরকার বলেছেন, অস্ত্রোপচারটা না হলে বোধ হয় কবিকে আরও কিছুদিন ওষুধের ওপর বাঁচিয়ে রাখা যেত।

৬ আগস্ট কবির অবস্থার চরম অবনতি ঘটে। তাঁকে স্যালাইন দেওয়া হয়। তাঁর সারা শরীরে তখন জ্বর ও ব্যথা। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, চিকিৎসকদের মতামতের দ্বন্দ্ব এ সময়েও ছিল চলমান। সেই দ্বন্দ্বে তাঁদের কেউ জিততে পারেননি, জিতলেন কবি একা। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, অস্ত্রোপচার তাঁকে বাঁচাতে পারবে না, বরং মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করবে। তাঁর এই বিশ্বাসই জয়ী হলো। ৭ আগস্ট মহাপ্রস্থান ঘটল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের। সেদিন ছিল রাখী পূর্ণিমা। আলোর ভুবনে ভেসে গেলেন মরণবিজয়ী রবীন্দ্রনাথ। এভাবে বাইশে শ্রাবণ হয়ে উঠল বাঙালির জীবনে সবচেয়ে শোকাবহ পূর্ণিমার প্রতীক।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলোর অন্য আলো-তে, ৬ আগস্ট ২০২১। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।