Media School

Dhaka    Sunday, 28 April 2024

By রাজীব সরকার

নজরুলের দুটি বিশেষ ভূমিকা

Media School May 27, 2021

স্বদেশের মাটিতেই নজরুল সন্ধান পেয়েছিলেন কাব্যের কল্পতরুর বীজ।

জীবনের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়ে ‘ঐকতান’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেন: ‘কৃষাণের জীবনের শরিক যে জন,/ কর্মে ও কথায় সত্য আত্মীয়তা করেছে অর্জন,/ যে আছে মাটির কাছাকাছি,/ সে কবির বাণী-লাগি কান পেতে আছি।/ সাহিত্যের আনন্দের ভোজে/ নিজে যা পারি না দিতে নিত্য আমি থাকি তারি খোঁজে।/ সেটা সত্য হোক,/ শুধু ভঙ্গি দিয়ে যেন না ভোলায় চোখ।/ সত্য মূল্য না দিয়েই সাহিত্যের খ্যাতি করা চুরি/ ভালো নয়, ভালো নয় নকল সে শৌখিন মজদুরি।’

কৃষকের জীবনঘনিষ্ঠ, মৃত্তিকাসংলগ্ন সাহিত্যের অপেক্ষায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। নিন্দা করেছিলেন শিল্পী-সাহিত্যিকদের শৌখিন মজদুরির। সাহিত্য সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে নজরুলও একই মত পোষণ করতেন। ‘জনসাহিত্য’ প্রবন্ধে তিনি বলেছিলেন: ‘জনসাহিত্যের উদ্দেশ্য হলো জনগণের মতবাদ সৃষ্টি করা এবং তাদের জন্য রসের পরিবেশন করা। আজকাল সাম্প্রদায়িক ব্যাপারটা জনগণের একটা মস্ত বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে; এর সমাধানও জনসাহিত্যের একটা দিক। ... যাঁদের গ্রামের অভিজ্ঞতা আছে, তাঁরা সেখান থেকেই তাঁদের সাহিত্য আরম্ভ করুন। স্থায়ী সাহিত্য চাই।’

জনসাধারণের সত্য আত্মীয়তা অর্জনের জন্য উন্মুখ ছিলেন নজরুল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস: ‘জনগণের সাথে সম্বন্ধ করতে হলে তাদের আত্মীয় হতে হবে। তারা আত্মীয়ের গালি সহ্য করতে পারে, কিন্তু অনাত্মীয়ের মধুর বুলিকে গ্রাহ্য করে না। ...আজকাল আমাদের সাহিত্য বা সমাজনীতি সবই টবের গাছ। মাটির সাথে সংস্পর্শ নেই। কিন্তু জন-সাহিত্যের জন্য জনগণের সাথে যোগ থাকা চাই। যাদের সাহিত্য সৃষ্টি করব, তাদের সম্বন্ধে না জানলে কি করে চলে?’

অন্যদিকে তিরিশের সাহিত্য আন্দোলনের তথা আধুনিক কবিতার অন্যতম প্রতিনিধি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ‘কাব্যের মুক্তি’ প্রবন্ধে ঘোষণা করেছিলেন: ‘বিশ্বের সেই আদিম উর্বরতা আজ আর নেই; এখন সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ না করলে, কাব্যের কল্পতরু জন্মায় না।’

সারা ব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বীজ সংগ্রহ করার মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বীজ রোপণের জন্য নিজস্ব ভূমি প্রয়োজন। সেই ভূমির সন্ধান পাশ্চাত্য আদর্শে লালিত তিরিশের কবিগণ পাননি; সন্ধান পেয়েছিলেন নজরুল। সাহিত্যিক প্রেরণা লাভের জন্য নজরুলকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজে বেড়াতে হয়নি, স্বদেশের মাটিতেই তিনি সন্ধান পেয়েছিলেন কাব্যের কল্পতরুর বীজ।

আধুনিক যুগের বাংলা কবিতার সূত্রপাত মাইকেল মধুসূদন দত্তের হাতে, এবং যা পূর্ণ মহিমায় বিকশিত হয় ও বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে রবীন্দ্রনাথের স্পর্শে। কিন্তু বাংলা কবিতা থেকে যায় অল্পশিক্ষিত পাঠকসাধারণ তথা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নাগালের বাইরে। নজরুলের অন্যতম কৃতিত্ব বাংলা কবিতাকে প্রান্তিক জনগণের সঙ্গে সংযুক্ত করা। কৃষক, শ্রমিক, তাঁতি, জেলে, মুচি, কুলি, বারাঙ্গনা—সমাজের নিচুতলায় বসবাসকারী এই জনগোষ্ঠী নজরুলের মাধ্যমেই বাংলা কবিতায় প্রবেশাধিকার অর্জন করছে। কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রে একই কৃতিত্বের দাবিদার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাহিত্যের সমাজতত্ত্বের দিক থেকে এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

নজরুলের দ্বিতীয় বিশেষ ভূমিকা হচ্ছে, বাঙালি মুসলমানের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সম্পর্ককে নিবিড় করা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সূচনালগ্ন থেকেই হিন্দু সাহিত্যিকদের প্রাধান্য ছিল। তাঁদের সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে স্বভাবতই হিন্দু চরিত্রের আধিপত্য ছিল। স্বভাবতই এই বেগবতী সাহিত্য ধারার সঙ্গে বাঙালি মুসলমান একাত্ম হতে পারেনি। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম স্বাতন্ত্র্য চেতনা প্রবল হতে শুরু করে, যা একসময় পাকিস্তান আন্দোলনে পরিণত হয়। নেতৃস্থানীয় মুসলমান ব্যক্তিবর্গের একাংশ স্বতন্ত্র ইসলামি বাংলা সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছে (চল্লিশের দশকে এমনকি রবীন্দ্রনাথকে বর্জন করার কথাও কারও কারও মুখে উচ্চারিত হয়েছে)। এমন কিছু ঘটলে বাংলা সাহিত্য বিভক্ত হয়ে যেত। এই দুর্ঘটনা থেকে বাংলা সাহিত্যকে রক্ষা করেছেন নজরুল। তাঁর সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়েই বাংলা সাহিত্যের মূল স্রোতে অবগাহন করেছে বাঙালি মুসলমান। হিন্দু পুরাণ ও ইসলামি ঐতিহ্য—উভয় উৎস থেকে সমান নৈপুণ্যে উপকরণ সংগ্রহ করে অসাধারণ সৃষ্টিসম্ভার উপহার দিয়েছেন নজরুল। এই যুগল কাব্য স্রোতের রসাস্বাদন করতে বাঙালি মুসলমান দ্বিধা করেনি।

বাঙালি মুসলমানের বাংলা সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ সৃষ্টির প্রধান ভূমিকা নজরুলের। সাম্প্রদায়িকতা ও বিদ্বেষ পরিহার করে উদারতার মধ্য দিয়েই যে স্থায়ী সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারে, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি: ‘সাহিত্যিকের, কবির, লেখকের প্রাণ হইবে আকাশের মতো উন্মুক্ত উদার, তাহাতে কোনো ধর্মবিদ্বেষ, জাতিবিদ্বেষ, বড়-ছোট জ্ঞান থাকিবে না। বাঁধ দেওয়া ডোবার জলের মতো যদি সাহিত্যিকের জীবন পঙ্কিল, সংকীর্ণ, সীমাবদ্ধ হয়, তাহা হইলে তাঁহার সাহিত্যসাধনা সাংঘাতিক ভাবে ব্যর্থ হইবে। তাঁহার সৃষ্ট সাহিত্য আতুঁড়ঘরেই মারা যাইবে। যাঁহার প্রাণ যত উদার, যত উন্মুক্ত, তিনি তত বড় সাহিত্যিক।’

আধুনিক বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে বাঙালি মুসলমানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে নজরুল একটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় নবসৃষ্ট রাষ্ট্র পাকিস্তানে ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে, যার পরিণতিতে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলা সাহিত্যে নজরুলের অবিস্মরণীয় অবদানের পাশাপাশি এই বিশেষ দুটি ভূমিকা বাঙালির সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটিয়েছে।

*লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় দৈনিক প্রথম আলোঅন্য আলো-তে, ২৭ আগস্ট ২০২০। লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।