Media School

Dhaka    Thursday, 25 April 2024

By সজীব সরকার

নারীর ওপর শ্রেষ্ঠত্ব নয়

Media School July 4, 2020

বাংলাদেশের অর্থনীতি উত্তরোত্তর অগ্রগতি সাধন করছে, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় উন্নতি হচ্ছে, তা বলা যায় না। একটি সংস্কৃতির মৌল উপাদান হলো মানুষ। আর সেই সংস্কৃতিতে মানুষে মানুষে কী সম্পর্ক বা নারী-পুরুষে সম্পর্কের কী ধরন, তার ওপর সমাজের সার্বিক উন্নয়নের অনেকখানি যেমন নির্ভর করে, তেমনি এ সম্পর্ক একটি সমাজের অর্জিত উন্নয়নের নির্দেশকও বটে।

বাংলাদেশে কেবল নয়, আমাদের প্রতিবেশী অনেক দেশেই নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক মূলত ক্ষমতার সম্পর্ক। পশ্চিমের উন্নত দেশগুলোতে যে এর খুব ব্যতিক্রম ঘটেছে, ঠিক তা নয়। তবে এই পার্থক্য সেখানকার দেশগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম। পশ্চিমের বা ইউরোপের দেশগুলোতে শিক্ষার হার ও মান বেশি; সেখানে নারীর ক্ষমতায়ন বেশি। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেসব দেশে নারী-পুরুষের মধ্যে একটি সমতাপূর্ণ সম্পর্ক যেমন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, তেমনি যথেষ্ট উন্নয়নও সাধিত হয়েছে।

আমরা দেখব, একটি সংস্কৃতিতে যদি নারী ও পুরুষের মধ্যে উল্লম্ব (ভার্টিক্যাল) সম্পর্ক থাকে, তবে সে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়; সহনশীলতার কোনো স্থান সেখানে থাকে না। সে সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্ক রীতিমতো 'বোঝা' হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে সেই সমাজে অসমতাসঞ্জাত বহুবিধ অন্যায়-অপরাধ সংঘটিত হওয়ার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয়। এর বিপরীতে একটি সংস্কৃতিতে যদি নারী ও পুরুষের মধ্যে ক্ষমতা ও সমতার ভারসাম্য আনা যায় এবং এর মাধ্যমে এ দু'জনের মধ্যে যদি একটি আনুভূমিক (হরাইজন্টাল) সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায়, তবে সেই সমাজে নারী ও পুরুষের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে, অসমতার সুযোগ ক্রমেই কমে আসে। এর মাধ্যমে সমাজে কাঙ্ক্ষিত উন্নয়নের ধারায় গতি সঞ্চার করা সম্ভব হয় অন্তত দুটি কারণে :এক. নারী-পুরুষ উভয়েই আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে নিজেদের সমানভাবে নিয়োজিত করতে সক্ষম হয় এবং দুই. আধুনিক মানসিকতার উপস্থিতির কারণে অসমতাজনিত বৈষম্য, অন্যায়-অনাচার না থাকায় সমাজে পশ্চাৎপদতা লোপ পায়।

বাংলাদেশের বিদ্যমান সমাজ-কাঠামোয় আমরা দেখেছি, বিগত কয়েক দশকে প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে তথাকথিত 'ধর্মের' অজুহাতে পুরুষের পক্ষে ও নারীর বিপক্ষে নানা ধরনের প্রপাগান্ডার বিস্তার ঘটানো হয়েছে। দারুণভাবে পুরুষতান্ত্রিক সেসব প্রচারণার ফলে অনেক পুরুষের মনে এক ধরনের নারী-বিদ্বেষ জন্ম নিয়েছে; অনেক নারীও যে বুঝে বা না-বুঝে পুরুষতান্ত্রিক ভাবনায় আক্রান্ত হয়েছেন- সে প্রমাণও পাই আমাদের পরিবারেই। শুধু ধর্মের অজুহাতে নয়, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে আরও অনেক কারণেই নারী ও পুরুষের মধ্যে একটি দূরত্ব তৈরি হয়েছে বা তৈরি করা হয়েছে।

এই দূরত্বের বদৌলতে পুরুষ আজ এমন এক সমাজ সৃষ্টি করেছে, যেখানে নারীর কোনো 'ভয়েস' নেই; নারীকে এখানে কথা বলতে দেওয়া হয় না। এই সমাজে নারীর প্রতি পুরুষের শ্রদ্ধাবোধ নেই। এখানে নারীকে শুধু পুরুষের প্রয়োজন মেটানোর উপায় বা উপকরণ হিসেবে দেখা হয়। এই সমাজে পুরুষ ভাবতে শিখেছে, নিজের প্রয়োজনে সে নারীকে যথেচ্ছ ব্যবহার করতে পারে।

এই যে নারীর ব্যাপারে পুরুষের এমন অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক ও অসংবেদনশীল ধারণা; তা দূর করা দরকার। পুরুষের মধ্যে এই উপলব্ধি ঘটানো দরকার, নারী কখনোই পুরুষের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং তাদের সহযোগী, পুরুষের সহযাত্রী। পুরুষ কখনোই নারীর চেয়ে শ্রেয়তর বা শ্রেষ্ঠতর নয়, বরং উভয়েই সমান। প্রকৃতি দু'জনকেই সমান করে সৃষ্টি করেছে, কাউকে কারও ওপর শ্রেষ্ঠত্ব দেয়নি। দু'জনের মধ্যে শুধু কিছু পার্থক্য করেছে। কিন্তু বৈষম্য যা, তা পুরুষেরা সৃষ্টি করেছে; প্রকৃতি নয়।

'কেবল পুরুষের সমাজে' নারী মোটেও নিরাপদ নয়; নারী এখানে পুরুষের দ্বারা বৈষম্যের শিকার, পুরুষের বিদ্বেষের শিকার; নারী এখানে আক্রান্ত। নারী এই সমাজের অর্ধেক অংশ এবং তারও অধিকার পুরুষের ঠিক সমান- এই সত্যটুকু পুরুষের মেনে নিতে শিখতে হবে। আর মনে রাখতে হবে, নারীকে তার প্রাপ্য অধিকার দেওয়ার মানে তাকে করুণা করা নয়, তাকে সুযোগ দেওয়া নয়। বরং নারীর অধিকারের প্রতি সম্মান প্রদর্শন।

নারীর 'প্রভু' নয়; পুরুষকে হতে হবে নারীর সহযাত্রী, নারীর সহচর। নারীকে সমাজের সমান গুরুত্বপূর্ণ অর্ধেক অংশ হিসেবে মেনে নেওয়ার মধ্যে 'নৈতিক পরাজয়' নেই- এ সত্য পুরুষকে বুঝতে হবে। আর এ সত্য মেনে নিলে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে শুরু করে ব্যক্তিজীবনে নারীর ওপর পুরুষের কর্তৃত্বের জেরে সমাজে যে অসমতা ও অন্যায়-অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে, তা থেকে রেহাই মিলতে পারে সহজেই।

নারীর ওপর নানা ধরনের সহিংসতা যেসব হচ্ছে, তার একটি বড় কারণ হলো সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বিদ্যমান অসমতার সম্পর্ক, অশ্রদ্ধার সম্পর্ক। নারীর ক্ষমতায়নকে শ্রদ্ধা করতে শিখলে, নারীর অধিকারকে মেনে নিতে শিখলে এবং সার্বিকভাবে নারীকে শ্রদ্ধা করতে শিখলে একটি সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতারও আর কোনো সুযোগ থাকার কথা নয়।

একজন নারীই নিজের শরীরে পুরুষকে ধারণ করে এই পৃথিবীতে তার আগমন নিশ্চিত করে, তাকে বাঁচিয়ে রাখে, পরম যত্নে তাকে বড় করে তোলে। এ জন্য নারী নিজের সব ধরনের আনন্দ-আয়োজনকে বিসর্জন দেয়। তাই নারীর ওপর 'শ্রেষ্ঠত্ব' নয়, বরং নারীর প্রতি পুরুষের রয়েছে সীমাহীন ঋণ। এই উপলব্ধি পুরুষের মধ্যে জাগ্রত করা দরকার। এ জন্য পুরুষকে আগে নারী-পুরুষের মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে সৎ ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। পুরুষকে 'নিপীড়ক' নয়, সহমর্মী হতে হবে। দু'জনের মধ্যে সমানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, বিশেষ কোনো মহল যেন হীনস্বার্থে নারী ও পুরুষকে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে দাঁড় করিয়ে দিতে না পারে।

নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যে সহমর্মিতা, সমানুভূতি আর সহযোগীর সম্পর্ক গড়ে উঠলেই নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হতে পারে; কেবল আইন ও বিচার করে নয়।

[লেখাটি দৈনিক সমকাল-এ ৬ মে ২০১৯ প্রকাশিত হয়।]