Media School

Dhaka    Friday, 29 March 2024

By আহমেদ জাভেদ

ন্যায্যতা ও সমতা : ভুল থেকে শেখা

Media School September 11, 2021

আহমেদ জাভেদ। ছবি : প্রথম আলো।

২৬ আগস্ট ২০২১। আমি ডাক্তার দেখাতে যাচ্ছিলাম। সুরক্ষা নিয়েই বের হয়েছি। সঙ্গে ছিল আমার স্ত্রী। দুই সপ্তাহ আগে আমি কোভিড আক্রান্ত হয়েছি। ভাড়ায় চালিত একটি সিএনজি অটোরিক্সায় উঠলাম আমরা দুজন। ভাড়া ঠিক হল দুইশত টাকা। ভেবেছিলাম যাত্রাপথে সিএনজি চালককে অনুরোধ করে থেমে এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে নেব। যেতে যেতে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমি নানা বিষয়ে গল্প করছিলাম। সাংসারিক ব্যস্ততায় যেসব কথা আমাদের মধ্যে হয় না, সেগুলো। সিএনজি চালককে বললাম, পথে কোনো এটিএম বুথ দেখলে ও সুবিধাজনক মনে হলে একটু থামতে।

কিন্তু বিধি বাম। সেরকম কোনোকিছু আসার আগেই সিএনজিটির ব্রেক বা ক্লাসের (কোন একটির হবে) তার ছিঁড়ে যায়। তিনি গাড়িটি রাস্তার পাশে থামান। আমরা বলি যে, আমরা অপেক্ষা করতে রাজি আছি। আপনি চিন্তা করবেন না। আপনি এটি মেরামত করুন। তিনি বললেন যে, এখন গাড়ির ইঞ্জিন গরম। কিছুটা সময় লাগবে ঠাণ্ডা হতে। তারপর কাজ ধরা যাবে। সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার বেশি লাগবে। তবুও আমরা রাজি হলাম। কিন্তু তিনি সেটি গ্রহণ করবেন না। তিনি বললেন যে, আপনারা অসুস্থ রোগী, হাসপাতাল যাচ্ছেন, আপনাদের দেরি করানোটা ঠিক হবে না। তার বিবেচনা বোধ দেখে আমরা দুজনেই হতবাক। আর উনাকে তো আমরা বলিনি যে, ডাক্তার দেখানোর পাশাপাশি আমরা কিছু স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করাব যার জন্যে আমরা এখনও কিছু খাইনি।

তখন ঘড়ির কাঁটায় সকাল এগারোটা। রক্তের নমুনা দিয়েই খাবার খাবো। তিনি একইরকম অন্য একটি সিএনজি অটোরিক্সা থামালেন। সেই নতুন চালককে বললেন আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দিতে। কিন্তু নতুন চালকের জন্য চল্লিশ শতাংশ পথ বাকি থাকলেও তিনি ভাড়া হাঁকলেন দেড়শত টাকা। আমি বললাম মোট দুইশত টাকা ভাড়ার মধ্যে উনি যেহেতু অধিকাংশ পথ নিয়ে এসেছেন তার জন্য আগের চালককে দেড়শত টাকা দিলে আপনার জন্য বরাদ্দ থাকে পঞ্চাশ টাকা। নতুন চালক বললেন, আমি একশ বিশ টাকা হলে যাব, অন্যথায় নয়। এরপর আমি পুরোনো সদয় চালকটির দিকে তাকালে তিনি আমাকে বললেন যে, আমাকে একশত টাকা দিলেই চলবে। কিন্তু আমাদের কাছে নগদ অর্থ না থাকায় সে টাকাটুকুও নতুন চালক থেকে আমাদের ধার করে পুরোনো চালককে দিতে হয়। এতে আমার স্ত্রী ও আমি দুজনেই বেশ খারাপ বোধ করছিলাম। সংবেদনশীল সেই পুরোনো চালকটি কষ্ট পেলেও মুখে হাসি নিয়েই আমাদের সঙ্গের ব্যাগগুলো নতুন বাহনে উঠিয়ে আমাদের বিদায় দিলেন।

নতুন বাহনে চড়ে আমরা আলাপ করছিলাম ঘটনাটা নিয়ে। বারবারই আগের চালকটির মায়াভরা কথা মনে হচ্ছিল। টাকা উঠিয়ে দ্বিতীয় চালকের ভাড়া দেওয়ার সময় একশত বিশের জায়গায় দুই শত টাকা দিয়ে দিলাম। এবার আমার স্ত্রী আগের চেয়ে বেশ সরব হলো। বললো যে, এটি কোনোভাবেই ন্যায্য হয়নি। আমারও মনে হলো, ওতো ঠিকই বলছে যে, এটি ঠিক হয়নি। কিন্তু কেন? আজকের লেখাটি এটি দিয়েই শুরু।

কোনো কাজ যখন আমরা করি তার মূল্যায়ন আমরা কীভাবে করি? কাজটি করার আগে যেসব বিবেচনা করি আর কাজটি করে ফেলে পেছনে ফিরে দেখে যখন সিদ্ধান্তের মূল্যায়ন করি, এই দুই বিবেচনার ভিত্তিগুলোই বা কী? অতীতের নিরপেক্ষ মূল্যায়ন কি আমরা ‘নিষ্পক্ষ দর্শক’ হিসেবে করতে পারি? বিশেষ করে এই মুহুর্তের প্রয়োজন মেটানোর প্রবল উপযোগিতার আকর্ষণ থেকে মনকে নিষ্পক্ষ দর্শকে পরিণত করে সুস্থায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারি? আমাদের যাত্রাপথের ঘটে যাওয়া ঘটনায় কি আমরা অতীত সিএনজি চালক ভাইটির জন্যে কিছুটা ‘ইচ্ছাকৃত’ ও অসংবেদনশীল সিদ্ধান্ত নেইনি? দুুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হচ্ছে যে, হ্যাঁ করেছি। যেটি আমার স্ত্রীর বোধে ধরা পড়েছে ও এটি নিয়ে সে কথা বলতে শুরু করেছে। যেটুকু পথ আমরা পুরোনো চালকের ঘাড়ে চড়ে এলাম তার অবদানটির কথা বর্তমান উপযোগিতার টানে ‘উপেক্ষা’ করলাম।

উল্লিখিত ঘটনায় আমরা দুইজন গাড়িচালকের প্রতি কোনোরকম বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করা হয়েছিল কিনা তার বিচার করতে পারি। বিশেষ করে, এতে সমাজে বিদ্যমান অসম শ্রেণি-অবস্থানের ক্ষমতা থেকে কোনো সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরোক্ষ কোনো চাপ ছিল কিনা তার বিশ্লেষণ করতে পারি। কিন্তু কোনো স্থানে বা নির্দিষ্ট সময়ে বা কিংবা কোনো ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিচ্ছিন্ন যুক্তি প্রয়োগ- তা কতটা গ্রহণযোগ্য তা বিবেচনার দ্বন্দ্ব থেকে আমরা আরও কিছুটা এগোতে পারি। এক্ষেত্রে বৈষম্যের বিপরীতে সমদৃষ্টির দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করার কোনো চেষ্টা হয়েছিল কিনা তার ভাবনাও আসতে পারে।

সমদৃষ্টির আলোচনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে সে আলোচনা জোরালোভাবে আসেনি। যখন আমরা বৈষম্যের কথাটি বলি তখন আমরা আসলে কী বোঝাই? বোঝাই যে, কোনোকিছু মূল্যায়নের মূল ভিত্তি হবে সমদৃষ্টি। সমদৃষ্টির জায়গাটি বাস্তবে টিকে থাকছে না বলেই বৈষম্যের সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও আবার বৈষম্য টিকিয়ে রাখতে ও তার ধারাবাহিকতা রক্ষায় বস্তুগত আয়োজনও চালু রয়েছে। আবার সমদৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে বর্তমানে ও অতীতের ক্ষেত্রেও নানা প্রচেষ্টা ঘটার জ্ঞানগত ও চর্চার নানা ক্ষেত্রও রয়েছে।

আধুনিক সময়ে সমদৃষ্টির ভিত্তিতেই ন্যায্যতার দাবিটি অত্যন্ত শক্তিশালীভাবে তোলা যায়- তার ধারাটি প্রায় এককভাবে প্রতিষ্ঠা করেছেন দার্শনিক জন রলস। এ বিষয়ে তাঁর প্রথম লেখা ‘জাস্টিস অ্যাজ ফেয়ারনেস।’ উনিশশ আটান্ন সালে এ প্রবন্ধটি প্রথম প্রকাশিত হয়। তখনই রলসের চিন্তাটি ব্যাপক সাড়া ফেলে দেয়। পরে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, একাত্তর সালে, ‘আ থিয়োরি অব জাস্টিস’ গ্রন্থে এ তত্ত্বটিকে তিনি আরও পরিশীলিতভাবে ও উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যান। রলসের আসল কথাটি ছিল, ন্যায্যতাকে বুঝতে হবে সমদৃষ্টির দাবির ভিত্তিতে। অর্থাৎ সমদর্শিতাই হল ন্যায্যতা নির্মাণের মূল ভিত্তি। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি বা সমাজ যদি ন্যায্যতায় পৌঁছতে চায় তবে তাকে সমদর্শিতার ভিত্তিভূমিতেই হাঁটতে হবে। এই পথে হেঁটেই সেখানে পৌঁছতে হবে। আমার মতে, রলসের এই ধারণার সমান্তরালে অমর্ত্য সেনের ‘ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম’ গ্রন্থে উক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ফ্রিডম (তাঁর ভাষায় যেটি সক্ষমতা)-এর পরিধি বাড়িয়ে তুলতে হলে প্রস্তাবিত ক্যাপাবিলিটি অ্যাপ্রোচ (সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গি) গ্রহণ করতে হবে। সক্ষমতার দৃষ্টিভঙ্গিটি বাংলাদেশের জন্য যে কতোটা গুরুত্বপূর্ণ তা একটু ভালোভাবে লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় যে, আমাদের বিদ্যায়তনিক পরিসরগুলো থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজের সকল প্রতিষ্ঠান ও অপ্রতিষ্ঠানে এই অতি প্রয়োজনীয় মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিটি কতোটা উপেক্ষিত। কিন্তু এই লেখায় এই আলোচনা মূলতবি রাখতে হচ্ছে।
 
রলসের সমদর্শিতাই ন্যায্যতা ধারণাটি কেবল সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকে বোঝাই যথেষ্ঠ নয় বরং ন্যায্যতার প্রায় সব তত্ত্বে এটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এখানে তত্ত্বকথা আসবে কেন? কারণ, কোনো একটি নির্দিষ্ট সময়ের ও স্থানের ঘটনাকে ‘বদ্ধ নিষ্পক্ষ’ গণ্ডির বাইরে প্রসারিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তালেবানরা এ ভুলটিই করছে। কারণ, বিশেষ ধর্মীয় ও নৈতিক আচরণ সমেত বদ্ধ এই গোষ্ঠিসমূহ কেবলমাত্র তাদের বিচ্ছিন্ন যুক্তিচর্চার রত। বিশ্বের অন্যান্য সমাজ ও সংস্কৃতির রূপান্তরগুলোর সঙ্গে কতোটা পরিপুষ্ট আদান-প্রদানে তারা সক্ষম- এ প্রশ্নটি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। অমর্ত্য সেনের মতে আফগানিস্তানে ‘তালেবান শাসনের... ‘বদ্ধ নিষ্পক্ষতা’র পদ্ধতিটির সঙ্গে কার্যত বিশ্বজনীন ধ্যানধারণা ও অভিপ্রায়গুলোর সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করা হয়, তখন (তাদের) পদ্ধতিগত সংকীর্ণতা একটা বিশেষ বাধা হয়ে দাড়ায়’ (নীতি ও ন্যায্যতা, পৃ : ১৮০)।

সেদিন আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভেতরের সারবস্তুর মূল্যায়নের অনুসন্ধানে নেমেই এই ভ্রমণ করতে হচ্ছে। কার্যত বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন চিন্তাভাবনা, অভিপ্রায় ও সর্বজনীন ভাবধারারও সমন্বয় ঘটানোর চেষ্টা করার একটি সুফল পাওয়া যেতে পারে। আর যদি সেটি করা সম্ভব হয়, তবে সমদর্র্শিতার পথে হাঁটার বাধাগুলো কাটিয়ে ন্যায্যতার সদর দরজায় উপস্থিত হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়।

এই জায়গায় এসে আমাদের অর্থশাস্ত্রের জনক অ্যাডাম স্মিথের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সাহায্য নিতে হবে, যদিও সময়ের ক্রমে রলস আমাদের নিকটবর্তী এবং অ্যাডাম স্মিথের সময় আজ থেকে প্রায় তিনশ বছর আগের এবং তিনি আমাদের থেকে বহুদূরের, অন্য গোলার্ধের (স্কটিশ) বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু রলসের চিন্তাটি পরিপূর্ণভাবে বুঝতে ও এর কিছু সীমাবদ্ধতা কাটাতে স্মিথ আমাদের আরও প্রশস্ত রাস্তা দেখান। আর তাই আমার কাছে মনে হয়েছে যে, বিভিন্ন সামাজিক অবস্থার মূল্যায়নে অ্যাডাম স্মিথের ‘নিষ্পক্ষ দর্শক’ (ইম্পারসিয়াল স্পেক্টেটর) ধারণাটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। স্মিথের বন্ধু দার্শনিক ডেভিড হিউম যুক্তিশীলতার প্রয়োগে মানব সংবেদনশীলতার গুরুত্ব জোরালোভাবে সামনে আনলেও স্মিথ হিউমের মতো ভাবতেন না। কিন্তু মানুষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাভিত্তিক ন্যায়-অন্যায় সম্পর্কে মানুষের প্রাথমিক উপলব্ধির জোরালো অনুভূতির যে কথা হিউম তাঁর দার্শনিক প্রবন্ধাবলিতে বলেছেন তার সঙ্গে স্মিথ একমত হলেও বহু ধরনের পরিস্থিতি ও এর পরিণামকে বা কার্যকারণ সম্পর্ককে স্মিথ যুক্তি দিয়েই বিচারের কথা বিপুলভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন। আর এই দৃষ্টিভঙ্গিকেই তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী দার্শনিক প্রকল্প হিসেবে তুলে ধরেছেন। এ ধারণাটিই হলো ‘নিষ্পক্ষ দর্শক’ (দ্য থিয়োরি অব মরাল সেন্টিমেন্টস’)।

নিজেদের জীবনযাপনের ভেতর দানা বেঁধে ওঠা কায়েমি স্বার্থ, নিজেদেরকে সামনে এগিয়ে রাখার ঝোঁক, অযৌক্তিক ভাবনা, নানা ধরনের সংস্কার ইত্যাদির প্রভাবমুক্ত হয়ে স্মিথের নিষ্পক্ষতার দাবিকে প্রধানভাবে সামনে আনতে হবে। কারণ, রলস প্রবর্তিত ‘সমদর্শিতাই ন্যায্যতা’ - এই পথে চলতে গেলে স্মিথের নিষ্পক্ষতার মৌলিক দাবিটিকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর তাছাড়া রলসের সমদর্শিতার তত্ত্ব ‘আদি অবস্থা’র ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত- সেটির কিছু কিছু সীমাবদ্ধতার উত্তরণেও স্মিথের নিষ্পক্ষতার চিন্তাটি দরকার হয়ে পড়বে। রলসের ‘অরিজিনাল পজিশন’ বা ‘আদি অবস্থা’ একটি কল্পিত পরিস্থিতি যেখানে সমাজের সকলে অজ্ঞানতার চাদরে ঢাকা থাকে। ব্যক্তিগত জীবনের স্বার্থ সম্পর্কে সবাই সেখানে উদাসীন এবং কেউই জানে না যে ভালো জীবন কাকে বলে। এমন কথা পাঠকের মনে কৌতুকের সৃষ্টি করলেও রলসকে এভাবে প্রারম্ভিক প্রস্থানের (পয়েন্ট অব ডিপার্চার) চিন্তনকণা সৃষ্টি করেই এগোতে হয়েছিল। যদিও এই পরিস্থিতি সৃষ্টির পটভূমিটি কৃত্রিম, রলসের নিজেরই কল্পিত, তবে রলস এর ভিত্তিতে ন্যায্যতার এক মৌলিক ভিত্তিভূমি সৃষ্টি করেছেন। শুধু তাই নয়, সূত্রগুলোকে বেশ শক্ত গাঁথুনিতে আঁটতে পেরেছেন। এর ভিত্তিতেই কেবল ন্যায্যতা সামনে এগোতে পারে। আর এই ন্যায্যতার ভিত্তিতেই সমাজে প্রতিষ্ঠানসমূহ সৃষ্টি হবে ও চলবে এবং এরই ভিত্তিতে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ন্যায্য সমাজের সন্ধান পাওয়া যাবে।

রলসের চিন্তার এই সুতাটি হাতে তুলে নেন অমর্ত্য সেন। আমাদের সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক অমর্ত্য সেন রলস-উত্তর ন্যায্যতা তত্ত্বের উন্নয়ন ঘটান। তিনি রলসের ধারণার ‘আদর্শবাদী চিন্তা’ থেকে বেরিয়ে তুলনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন অধিকতর ন্যায্যতার পথপদ্ধতির তত্ত্ব নির্মাণ করেন। অমর্ত্য সেনের মতে, রলসের ন্যায্যতার চিন্তাটি ‘ট্রান্সেনডেন্টাল থিওরি অব জাস্টিস’ বা ন্যায্যতার ‘সর্বশ্রেষ্ঠান্বেষী দৃষ্টিভঙ্গি’র ভিত্তিতে সৃষ্ট। অমর্ত্য সেনের ঝোঁকটি হলো এই মুহুর্তের বাস্তব অবস্থার গুণগত পরিবর্তনের জন্য ন্যায্যতার ধারণা ও প্রয়োগ কীভাবে কাম্য সমাজের দিকে নিয়ে যাবে তার ভিত্তি নির্মাণ করা। মোদ্দা কথা হলো, আমরা কীভাবে এগোতে পারি তার পথপদ্ধতির অনুসন্ধানের তাগিদ তিনি আমাদের দিয়েছেন। আমার মতে, অমর্ত্য সেন অত্যন্ত বুদ্ধিদীপ্তভাবে সময় পরিবর্তনের আঙ্গিকটি তাঁর ন্যায্যতার গতিশীল ভাবনায় সুস্থায়ীভাবে ধারণ করতে পেরেছেন। আমি এ বিষয়টির নাম দিয়েছি ‘ইনক্রিমেন্টাল জাস্টিস’ বা ‘ক্রমবর্ধমান ন্যায্যতা’র লক্ষ্যে আমরা কীভাবে এগোবো তার ধারণা ও চর্চার পথে সংগ্রাম করা। রলসের প্রতিষ্ঠান-ভিত্তিক ন্যায্যতা চিন্তার সীমাবদ্ধতা অমর্ত্য সেন আমাদের সামনে তাঁর ক্ষুরধার বিশ্লেষণী কাঠামোর মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। কারণ, অমর্ত্য সেন মনে করেন যে, আমরা যে পৃথিবীটায় বাস করি সেখানে প্রতিষ্ঠানগুলো ভুলত্রুটিমুক্ত নয় এবং যথাযথ আচরণও করে না। অমর্ত্য সেনের লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে যে, তিনি মনে করছেন কেবল প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্যতার ওপর আমাদের নির্ভরতা থাকলে- যেটি রলসের ন্যায্যতা চিন্তার একটি সীমাবদ্ধতা বলে তিনি (সেন) ব্যাখ্যা করেন, ব্যক্তির ন্যায্যতা পাওয়ার বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে যাবে। অমর্ত্য সেন বর্তমান সময়ের মহান এক শিক্ষক। তিনি আমাদের মনে করিয়ে দেন যে, পরিস্থিতি নির্ভরতার কথা বলে প্রতিষ্ঠানের চয়নের অন্যায্যতা থেকে ব্যক্তির ন্যায্যতা ও যৌক্তিক আচরণ নিশ্চিত করতে না পারলে ন্যায্যতা প্রাপ্তির ‘ক্রমবর্ধমান ন্যায্যতা’র পথে হাঁটা সম্ভব হবে না। তাঁর মতে, ‘বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের মানুষের স্বক্ষমতা, সক্ষমতা ও কল্যাণকে প্রসারিত করে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে’... প্রচলিত ‘নিয়মনীতি ও অভ্যাসকে বাস্তবের দৃষ্টিকোণ থেকে’ মূল্যায়নের প্রয়োজন আছে। অমর্ত্য সেনের মতে ন্যায্যতার পথে ‘সামাজিক বিভিন্ন অবস্থার মূল্যায়নে শুধুমাত্র তৃপ্তিযোগের ওপর নির্ভর করার কোনও আবশ্যকতা নেই’... এমনকি ‘অন্তিম অবস্থার ওপর নির্ভর করারও দরকার নেই। আমরা যথাযথ কাজ করছি, না আরও ভালো করতে পারতাম, সেটা বিচার করার ক্ষেত্রে সর্বাঙ্গীন পরিণামের খুবই গুরুত্ব রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ন্যায্যতার লক্ষ্যে যে জরুরি প্রশ্নটি নিরবিচ্ছিন্নভাবে থেকেই যায় তা হল, সবকিছু বাস্তবে কেমন চলছে এবং তাদের আরও ভালো করে তোলা যায় কি না’ (নীতি ও ন্যায্যতা, পৃ : ১১০)।
 
আমাদের ভাড়া মেটানোর অন্যায্যতার সিদ্ধান্তটি দুইজন চালকের জীবনমানের তারতম্য ঘটানোর কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা যায়। অর্থনীতিবিদ রবার্ট সোলোর সূত্র অনুসারে, সুস্থায়ী উন্নয়ন হবে এমন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম ‘জীবনধারণের অন্তত সেই মান অর্জন করতে পারে, যা বর্তমান প্রজন্ম ভোগ করছে, অনুরূপভাবে পরবর্তী প্রজন্মগুলোর ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য।’ তাঁর সূত্র নির্ধারণের কতকগুলো আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে। প্রথমত, জীবনধারণের মানকে টিকিয়ে রাখার ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে তিনি পরিবেশ রক্ষাকে একটা দিশা দিয়েছেন। দ্বিতীয়ত, সোলোর সূত্রে বলা হয়েছে, ভবিষ্যত প্রজন্মের চাহিদা পূরণের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং প্রত্যেক প্রজন্ম তার পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি লক্ষ্য রাখবে। সমস্ত প্রজন্মকে বিবেচনায় আনার মধ্য দিয়ে সোলো পরিবেশের ধারাবাহিকতার সমস্যাটিকে প্রশংসনীয়ভাবে সূত্রায়িত করেছেন। অমর্ত্য সেন সোলোর ধারণার কিছু সীমাবদ্ধতাও দেখিয়েছেন। অধ্যাপক সেন বলেন, ‘কিন্তু সোলোর সূত্রায়নও কি সুস্থায়ী উন্নয়নের পক্ষে যথেষ্ট? জীবনধারণের মান বজায় রাখার বিষয়ে তাঁর সূত্র প্রশংসনীয় (বিশেষত ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মগুলো যেন জীবনধারণের মান বজায় রাখতে পারে’, এই শর্তটি)। তা হলেও এই জীবনধারণের মান সমস্ত প্রাসঙ্গিক দিককে অন্তর্ভুক্ত করে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। বিশেষত, জীবনধারণের মান বজায় রাখা আর মানুষের সক্ষমতা (ক্যাপাবিলিটিস) ও স্বক্ষমতা (ফ্রিডম) রক্ষা করা- এই দুটি এক জিনিস নয়। কিছু বিশেষ সুযোগকে গুরুত্ব দেওয়ার অর্থ এই নয় যে, তা সর্বদা জীবনধারণের মান বা ব্যক্তিস্বার্থের সঙ্গে যুক্ত হবে।’ (সেন, ২০ জুলাই ২০২১ বণিক বার্তা)।

আমাদের পরিস্থিতিতে আমরা অত দূরের নয়, একটুখানি পরিস্থিতির তারতম্যে যে অন্যায্যতার প্রভাব পড়লো অন্তত প্রথম চালকের জীবনে তা মেটানো যাবে কীভাবে? আমার মধ্যে ঘটে চলা এই পুরো ভাবনাটির শুরু হয়েছিল আমার স্ত্রীর প্রশ্ন থেকে। তাঁর সংবেদনশীল মন পুরো বিষয়টিকে ফিরে দেখার জন্য আমাকে উৎসাহিত করেছে। ন্যায্যতার প্রশ্নে নারীর সংবেদনশীলতা ও যুক্তি প্রয়োগের প্রখরতা পুরুষের তুলনায় বেশি বলেই আমার মনে হলো। দার্শনিক ডেভিড হিউমের চিন্তা ও অনুজ্ঞাগুলো আমাদের শেখায় ‘মানব সংবেদনের (সেন্টিমেন্টস) জোরালো ভূমিকাটাকে অগ্রাহ্য না করেও যুক্তির গুরুত্বকে মেনে নেওয়া’, যদিও প্রচলিত চিন্তায় সংবেদনের ভূমিকাটাকে কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না। অমর্ত্য সেনের ভাষায় : ‘হিউমের অন্তর্দৃষ্টি আমাদের শেখায়, যাঁরা এই পৃথিবীর অন্যত্র, আমাদের থেকে বহু দূরে বাস করেন, এমনকি যাঁরা এখনও জন্মাননি, ভবিষ্যতে এই পৃথিবীর বাসিন্দা হবেন, তাঁদের কথা ভাবাও আমাদের দায়িত্ব।’ (সেন, ১০ ও ১১ জুন ২০২১ বণিক বার্তা)। হিউম যদিও সংবেদনশীলতার ক্ষেত্রে নারীর বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা অগ্রসরতার কথা সরাসরি বলেননি, তা সত্ত্বেও, যুক্তি প্রয়োগের সঙ্গে সংবেদনশীলতার চমৎকার সম্পর্কের প্রতি আমার আকর্ষণ তৈরি হলো। রবীন্দ্রনাথ ও অমর্ত্য সেন এ প্রসঙ্গে অনেক মূল্যবান দিক আমাদের সামনে উন্মোচন করেছেন। সেনের মতে ‘নারী ও পুরুষের মধ্যে বৈষম্যটি নানারূপে দেখা দিতে পারে'... বস্তুত এটি বহুবিধ সমস্যার একটি মিশ্র রূপ।’ (সেন, তর্কপ্রিয় ভারতীয়, ২০০৫)। কিন্তু ন্যায্যতার অনুসন্ধান ও প্রতিষ্ঠায় নারীর যুক্তিচর্চার সঙ্গে নিজস্ব সংবেদনশীলতার জোরালো ব্যবহার পুরো পরিস্থিতির ওপর কতটা অগ্রসর প্রভাব রাখতে পারে সেটি একটি বাস্তব ঘটনার মধ্যে দিয়েই উজ্জ্বল আলো ফেললো, অন্তত আমার জীবনে।
 
লেখাটি শেষ করব অমর্ত্য সেনের সদ্য প্রকাশিত ‘হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড : আ মেমোয়ার’ বা ‘স্মৃতিকথা : ঘরে-বাইরে’-এর মুখবন্ধের কিছু কথা দিয়ে। অমর্ত্য সেনের ভাষায় : ‘চিন্তাশীল সত্তা হিসেবে মানুষ হলো গঠনমূলক অভিজ্ঞতার বিশাল এক ভাণ্ডার। এক হাজার বছর আগে, প্রথম শতাব্দির শেষ দিকে ও এগারো শতকের প্রথম দিকে ইরানি গণিতজ্ঞ আল-বেরুনি বেশ কিছু বছর ভারতে ছিলেন। আল-বেরুনির সুলিখিত ‘তারিখ আল-হিন্দ’ গ্রন্থের এক জায়গায় তিনি মন্তব্য করেন যে, পরস্পরের কাছ থেকে শেখার বিষয়টি সমৃদ্ধ জ্ঞান ও সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। তিনি ভারতে থেকেই গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান, দর্শন ও চিকিৎসাশাস্ত্রে চমৎকার সব অবদান রেখে গেছেন। সেটি কম দিনের কথা নয়; আজ থেকে প্রায় এক সহস্রাব্দ আগেই তিনি দেখিয়েছেন যে, পারস্পরিক বন্ধুত্বের ভেতর দিয়ে কীভাবে জ্ঞানের পরিধি বাড়িয়ে তোলা যায়। ভারতীয়দের প্রতি আল-বেরুনির ভালোবাসা ভারতীয় গণিতশাস্ত্র ও বিজ্ঞানে তাঁর আগ্রহকে একদিকে যেমন বাড়িয়ে তুলেছে, ঠিক তেমনি এটিই ভারতীয় এসব শাস্ত্রে তাঁর নিজের সক্ষমতা বৃদ্ধির কারণ। যাই হোক, অবশ্য তাঁর এই মুগ্ধতা ভারতীয় বিদ্যাশাস্ত্র নিয়ে খানিকটা ঠাট্টায় বাধা হতে পারেনি। বেরুনির মতে, ‘ভারতীয় গণিতশাস্ত্র অসাধারণ পাণ্ডিত্যপূর্ণ, কিন্তু ভারতীয় পণ্ডিতদের অধিকাংশের ভেতরই কিছুটা ভিন্ন অস্বাভাবিক ক্ষমতা রয়েছে। তাঁরা অসাধারণ বাকপটু- এমনকি কোনো বিষয় সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা না থাকলেও তাঁরা সে বিষয়ে অনর্গল আলাপ চালিয়ে যেতে সক্ষম!’

সবশেষে বলব যে, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে সমতা প্রতিষ্ঠায় সম্পদের সামাজিক মালিকানার যে দাবিটি আছে তাকে ‘সর্বশ্রেষ্ঠান্বেষী প্রকল্প’ হিসেবে না দেখে, ব্যক্তি মানুষের বোধের উন্নয়নের দৃষ্টিকোণের মাধ্যমে বুঝলেও পরিস্থিতির নবতর উন্নয়ন ঘটানো যেতে পারে। এতে অচল ঘরটির দরজা-জানালা কিছুটা খুলে দেওয়া যায়। এমন সম্ভাবনাকে এড়িয়ে যাওয়া কিছুতেই কাম্য বলে মনে করি না। আর কে না জানে, জানালা খুলে দিলে ঘরে অবারিত আলো-বাতাস ঢোকার সুযোগ ঘটবে। কারণ, মানুষ ভুল থেকেই শেখার পরিধি বাড়িয়ে তুলতে পারে।

আহমেদ জাভেদ : দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অর্থনীতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ও বাঙলার পাঠশালা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। বর্তমানে তিনি বাংলা ভাষায় অমর্ত্য সেন পাঠচক্রের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর সর্বশেষ সম্পাদিত গ্রন্থ 'বাংলাদেশের সংবিধান : নানা প্রসঙ্গ' (গ্রন্থটির ভূমিকা লিখেছেন সদ্য প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান) প্রকাশিত হয় অন্যপ্রকাশ থেকে ২০২০ সালে। ভারতের আনন্দ পাবলিশার্স থেকে সম্প্রতি অমর্ত্য সেনের বক্তৃতা ও সাক্ষাতকারভিত্তিক 'বলা যায়' গ্রন্থে আহমেদ জাভেদের একটি অনুবাদ সংকলিত হয়েছে। অমর্ত্য সেনের বহুল প্রতীক্ষিত আত্মজীবনী 'হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড : আ মেমোয়ার' (স্মৃতিকথা : ঘরে-বাইরে) প্রকাশিত হয়েছে ২০২১ সালের জুলাই মাসে বিখ্যাত পেঙ্গুইন বুকসের অ্যালেন লেন প্রকাশনী থেকে। অমর্ত্য সেন নতুন এ বই বাংলায় অনুবাদ করার লিখিত অনুমতি আহমেদ জাভেদকে দিয়েছেন এ বছরের আগস্ট মাসে।