By সজীব সরকার
প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ-এর নানা বৈশিষ্ট্য
Media School September 14, 2025

বিখ্যাত কোনো ব্যক্তি অথবা গল্প-উপন্যাসের বিখ্যাত কোনো চরিত্রের সঙ্গে পাঠক বা দর্শক যে একটি আবেগনির্ভর সম্পর্ক অনুভব করে, সেটিই হলো প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ (parasocial relationship)। এটি একপাক্ষিক এমন এক সম্পর্ক যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে সরাসরি কোনো পরিচয়, যোগাযোগ বা মিথষ্ক্রিয়া (interaction) থাকে না। এখানে সাধারণ ব্যক্তিটির (দর্শক, পাঠক বা ভক্ত) সম্বন্ধে ওই সেলিব্রিটির কোনো ধারণাই থাকে না।
এবার এ ধরনের সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বৈশিষ্ট্য দেখে নেওয়া যাক :
প্রথমত : প্যারাসোশ্যাল রিলেশনশিপ হলো একতরফা বা একপাক্ষিক একটি সম্পর্ক।
কারণ, এ ধরনের সম্পর্ক কোনো গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব বা তারকা, পাবলিক ফিগার কিংবা কল্পিত কোনো চরিত্রের সঙ্গে গড়ে ওঠে। এ ক্ষেত্রে, ওই তারকা বা পাবলিক ফিগার অপর ব্যক্তিটিকে চেনে না। মেসি, রোনালদো, ব্রাডম্যান কিংবা লারার মতো খেলোয়াড়; টম ক্রুজ, শাহরুখ খান, দীপিকার মতো তারকা; কিংবা আয়রনম্যান, ব্যাটম্যান, সুপারম্যান, কমিক চরিত্র টিনটিন - এদের সঙ্গে ভক্ত-অনুরাগীদের দেখা-সাক্ষাৎ ঘটে না এবং সত্যিকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। ফলে, এ সম্পর্ক সবসময় একতরফাই থেকে যায়। কেননা, এখানে ব্যক্তি যার সঙ্গে নিজের একটি 'সম্পর্ক' গড়ে তোলে, ওই ব্যক্তিটি প্রথম ব্যক্তিটির অস্তিত্ব সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল থাকে না।
দ্বিতীয়ত : এ ধরনের সম্পর্ক মূলত গণমাধ্যম ব্যবহারের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ও টিকে থাকে।
একজন ব্যক্তি মূলত গণমাধ্যমের বদৌলতেই কোনো খেলোয়াড়, গায়ক, অভিনেতা, গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি বা গল্প-উপন্যাসের (কল্পিত) চরিত্রের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠে। নিয়মিত গণমাধ্যম ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যক্তিদের সঙ্গে গণমাধ্যম ব্যবহারকারীর নিয়মিত 'দেখা-সাক্ষাৎ' ঘটে। এই দেখা-সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ নয়; পরোক্ষ। টিভির পর্দায় বা পত্রিকার পাতায়ই তো মূলত আমরা আমাদের প্রিয় অভিনয়শিল্পী, লেখক, খেলোয়াড় বা এমন অন্য ব্যক্তিদের দেখি। আজ-কাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ব্যবহার অনেক বেশি; ফলে, প্রিয় ব্যক্তিদের সঙ্গে এই পরোক্ষ দেখা-সাক্ষাৎ সেখানে আরো বেশি হচ্ছে।
তৃতীয়ত : এ সম্পর্ক গড়ে ওঠে মূলত আবেগের ভিত্তিতে।
গণমাধ্যমের বদৌলতে প্রিয় ব্যক্তিদের সঙ্গে এই যে একধরনের মিথষ্ক্রিয়া, এর ফলে সাধারণ একজন ব্যক্তির সঙ্গে ওই চরিত্রগুলোর একটি আবেগীয় সম্পর্ক ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে। এ সম্পর্কগুলো সামাজিক অন্য সম্পর্কগুলোর অনুকরণে অনেকটা সেগুলোর মতোই রূপ নিতে থাকে। প্রিয় ব্যক্তিদের খবর বা ছবি দেখলে আমরা আনন্দিত হই। অনেক সময় তাদের কোনো কাজে আচরণে বিরক্ত বা রাগ হই। অনেকেই আমরা তাদের দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হই। অনেকে তাদের পোশাক বা আচরণ অনুকরণ বা অনুসরণ করে। নিজের শরীরে প্রিয় তারকার ছবি ট্যাটু করে। ভক্তরা দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে প্রিয় তারকাদের শো-এর টিকিট কাটে। প্রিয় তারকার কোনো ম্যাচ বা সিনেমা দেখতে, কিংবা গান শুনতে কনসার্টের টিকিট কাটায় উন্মাদনার চিত্র - এগুলো সব এই আবেগেরই প্রকাশ।
প্যারাসোশ্যাল সম্পর্কের ইতিবাচক দিক
একাকিত্ব থেকে মুক্তি : এ ধরনের সম্পর্কের ফলে ব্যক্তির একাকিত্ব কমতে পারে। কিছু মানুষ থাকে যারা চারপাশের মানুষদের সঙ্গে সহজভাবে মিশতে পারে না। অথবা, হয়তো তার পরিচিত মানুষজনের থেকে দূরে বসবাস করে। এসব ক্ষেত্রে প্রিয় কোনো তারকা বা ব্যক্তিত্বকে গণমাধ্যমে দেখে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় নিয়মিত ফলো করার মাধ্যমে ওই ব্যক্তি তার একাকিত্ব কিছুটা হলেও ভুলে থাকতে পারে।
ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়ন : নানা ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের কাউকে 'আইডল' হিসেবে ধরে নিয়ে, তাকে অনুসরণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত ও পেশাগত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি : অনেক ক্ষেত্রে তারকা বা পছন্দের এমন ব্যক্তিদের জীবনের গল্প, তাদের সংগ্রামের গল্প ও সফল হওয়ার গল্প থেকে তাদের ভক্ত-অনুসারীরা হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পায়।
প্যারাসোশ্যাল সম্পর্কের নেতিবাচক দিক
এ ধরনের সম্পর্ক সবসময় যে ভালোকিছুই দেবে, এমনটি নয়; কিছু ক্ষেত্রে তা নেতিবাচক ঘটনায়ও রূপ নিতে পারে। আগেই বলা হয়েছে- এ ধরনের সম্পর্কের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে ব্যক্তির আবেগ; এ আবেগ অনেক সময় অস্বাভাবিক বা বিপজ্জনক হয়ে উঠতেও দেখা যায়। যেমন :
মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি : পছন্দের তারকার প্রতি অতিরিক্ত আবেগ বা আকর্ষণ ব্যক্তির মধ্যে অস্বাভাবিকতা, উগ্রতা, ডিপ্রেশন, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা (সোশ্যাল আইসোলেশন) ইত্যাদি সমস্যা তৈরি করতে পারে।
সহিংসতা : ফুটবলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে 'কে সেরা' - এ বিতর্কে বাংলাদেশে এ দুই দেশের সমর্থকদের মধ্যে একাধিকবার মারামারি এবং এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে একসময়ের জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুতে শোকাহত একাধিক ভক্ত আত্মহত্যা করেছিলেন বলে জানা যায়। এ ছাড়া, বিভিন্ন দেশে দেখা গেছে, প্রিয় তারকার দেখা পেতে বা তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে গিয়ে ভক্তদের কেউ কেউ রীতিমতো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হয়ে প্রিয় তারকার প্রতি অতিমাত্রায় বিদ্বেষ থেকে তাকে নানাভাবে হুমকি দেওয়া, বিপদে ফেলা, তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা এমনকি ভক্তের আত্মহত্যার ঘটনাও দেখা গেছে বিভিন্ন সময়। বলিউডে ২০১৬ সালে মুক্তি পাওয়া শাহরুখ খান অভিনীত চলচ্চিত্র 'ফ্যান'-এ এমনই এক ভক্তের ক্রমান্বয়ে 'অবসেসড' ও শেষ পর্যন্ত সহিংস হয়ে ওঠার গল্পই দেখানো হয়েছে।
অবাস্তব বা অস্বাভাবিক প্রত্যাশা : কল্পিত এ সম্পর্ক অনেক সময় ভক্তদের মধ্যে অবাস্তব বা অস্বাভাবিক প্রত্যাশার জন্ম দেয়। কেউ হয়তো তার পছন্দের ব্যক্তি বা তারকার সঙ্গে 'রোম্যান্টিক' সম্পর্কের ফ্যান্টাসিতে ভুগতে শুরু করতে পারে যা ওই ভক্তর জন্য বা দুজনের জন্যই জটিলতা তৈরি করতে পারে। যেমন : অনেকের কাছে হিন্দি সিনেমার প্রথম 'সুপারস্টার' রাজেশ খান্না; নারী ভক্তদের কেউ কেউ হাত কেটে নিজের রক্ত দিয়ে তাকে প্রেমপত্র লিখে পাঠাতো বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ভক্তদের এমন কর্মকাণ্ডে অনেক তারকার ব্যক্তিগত জীবন, সাংসারিক জীবন, সামাজিক জীবন এমনকি ক্যারিয়ার পর্যন্ত বিপর্যস্ত হওয়ার অনেক নজির রয়েছে।
গণমাধ্যমের প্রতি আসক্তি : প্রিয় তারকাকে অনুসরণ করতে গিয়ে ভক্তের মধ্যে গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের প্রতি আসক্তি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
বাস্তব জীবন ও বাস্তব সম্পর্কের ক্ষতি : কাল্পনিক এক সম্পর্কের প্রতি বেশি মনোযোগী বা আসক্ত হয়ে পড়লে ব্যক্তির স্বাভাবিক জীবন ও সত্যিকার সম্পর্কগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ফলে, প্যারাসোশ্যাল এ সম্পর্কের মাত্রা স্বাভাবিক সীমা ছাড়াচ্ছে কি না, এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা জরুরি।