Media School

Dhaka    Thursday, 02 May 2024

By রাজীব সরকার

ব্যাকরণের বাইরে থেকে

Media School June 27, 2020

প্রমথ চৌধুরী লিখেছিলেন, ‘ভাষা মানুষের মুখ থেকে কলমের মুখে আসে। উল্টোটা করতে গেলে মুখে শুধু কালি পড়ে।’ ব্যাকরণের নামে রক্ষণশীলতার দুর্গে যাঁরা ভাষার গতিপ্রবাহকে রুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন, তাঁদের উদ্দেশেই প্রমথ চৌধুরীর এই উক্তি। উক্তিটির প্রাসঙ্গিকতা যে এ যুগেও শেষ হয়ে যায়নি, সে কথা মনে করিয়ে দিল শিশির ভট্টাচার্য্যের যা কিছু ব্যাকরণ নয় বইটি।

আটটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত বইটিতে বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ সম্পর্কে যেসব প্রচলিত ধারণা রয়েছে, সেগুলো খণ্ডন করার চেষ্টা করা হয়েছে। ‘বাংলা ভাষার তথাকথিত অবক্ষয় বনাম অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা: একটি পর্যালোচনা’ অধ্যায়ের শিরোনাম দেখেই বোঝা যায়, বাংলা ভাষার সাম্প্রতিক ‘অবক্ষয়’ নিয়ে যাঁরা চিন্তিত, লেখক তাঁদের দলভুক্ত নন। তাঁর দৃষ্টিতে এটি ‘তথাকথিত অবক্ষয়’। বিভিন্ন ভাষার ব্যাকরণরীতি বিশ্লেষণ করে লেখক দাবি করেছেন, প্রমিত উচ্চারণ বা উচ্চারণ শুদ্ধতাকে প্রাধান্য না দিয়েই পৃথিবীর নানা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান করা হয়। এতে উচ্চশিক্ষা ব্যাহত হয় না। কিন্তু এ কারণে প্রমিত বাংলা বা শুদ্ধ উচ্চারণের কথা বলার প্রয়োজনীয়তা কি কমে যায়? তিনি লিখেছেন, ‘প্রমিত বাংলা অনেকের কানে শ্রুতিমধুর শোনায়, আঞ্চলিক বাংলা, আঞ্চলিক উচ্চারণরীতি অসহ্য লাগে। শ্রতিমাধুর্য একটি আপেক্ষিক ব্যাপার।’ আপেক্ষিকতার কথা বলে কি মাধুর্য বা সৌন্দর্য থেকে আমরা মুখ ফিরিয়ে নেব? নিশ্চয়ই চৌরাসিয়ার বাঁশি, রবিশংকরের সেতার, পিকাসোর চিত্রকর্ম সবাই উপভোগ করেন না। এ জন্য কি তাঁদের শিল্পকর্মের গুরুত্ব লঘু হয়ে যায়? আবার বাংলা ভাষার অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি যে চার দফা প্রস্তাব দিয়েছেন, এর মধ্যে অন্যতম হিসেবে উল্লেখ করেছেন, শিক্ষার মাধ্যম হবে শুধুই প্রমিত বাংলা।

‘লিঙ্গবৈষম্য ও ভাষা’ অধ্যায়ে একটি জরুরি বিষয়ে আলোকপাত করেছেন শিশির ভট্টাচার্য্য। অন্য যেকোনো ভাষার মতো বাংলা ভাষায়ও পুরুষ কর্তৃক নারীকে অপমান করার জন্য শব্দভান্ডার রয়েছে, আবার পুরুষের বিরুদ্ধে ব্যবহারযোগ্য শব্দেরও অভাব নেই। লেখক যথার্থই বলেছেন যে সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তন হলেই নারীবাচক অশ্লীল শব্দ অব্যবহৃত হতে হতে ধীরে ধীরে লুপ্ত হতে পারে। এটি লক্ষণীয় যে একই বিশেষণ নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন অর্থ বহন করে। নায়ক ‘ক’ চলচ্চিত্রে সাহসী শট দিয়েছেন। নায়িকা ‘ছ’–ও সাহসী শট দিয়েছেন। নায়ক সাহসী, কারণ তিনি ঝুঁকিপূর্ণ দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। নায়িকা সাহসী, যেহেতু তিনি স্বল্পতম বসনা হয়ে অভিনয় করেছেন।

এই বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ‘বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষা’। বাংলাদেশের একটি বড় জনগোষ্ঠি জীবিকার তাগিদে বিশ্বের নানা দেশে বসবাস করেন। স্বদেশের ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে মমত্ব তারা অনুভব করেন, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম সেই অনুভূতি থেকে বঞ্চিত। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখক দেখেছেন, বহির্বিশ্বে পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ষোলোই ডিসেম্বরের মতো জাতীয় উৎসবগুলো পালিত হয়। এই আয়োজনগুলোতে প্রথম প্রজন্মের বাংলাভাষীরা আগ্রহের সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা এ ক্ষেত্রে কোনো স্বাচ্ছন্দ্য অনুভব করে না। এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রেও লেখক গুরুত্ব দিয়েছেন বাণিজ্য, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, প্রশাসনসহ জীবনের সবক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে বাংলা ভাষা চর্চাকে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করাকে।

বাংলা বানানের সংস্কার নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন লেখক। ‘বাংলা একাডেমির সরকারি ব্যাকরণ এবং কিছু দরকারি কথা’ অধ্যায়ে বাংলা একাডেমি প্রকাশিত দুই খণ্ডের ‘প্রমিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ’ বই নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন শিশির ভট্টাচার্য্য। লেখকের অভিমত, বাংলা একাডেমির এই উদ্যোগ মহৎ, কিন্তু লক্ষ্যভেদ হয়নি। প্রকৃত বাংলা ব্যাকরণ প্রণয়ণের স্বপ্নপ্রকল্প যে তিমিরে ছিল, প্রকৃতপক্ষে সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।

শিশির ভট্টাচার্য্য এ দেশের বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী। বাংলা ভাষা ও ব্যাকরণ নিয়ে অনুসন্ধিৎসু গবেষক–পাঠকদের ভাবনা-চিন্তায় নতুন দিগন্ত উন্মোচনের জন্য বইটি অবশ্যপাঠ্য।

[লেখাটি দৈনিক প্রথম আলো-এ ৩০ আগস্ট ২০১৯ প্রকাশিত হয়; লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]