Media School

Dhaka    Thursday, 28 March 2024

By মিডিয়াস্কুল

‘ভালো সাংবাদিক হতে অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও আগ্রহ প্রয়োজন’

Media School April 21, 2021

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যারা সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করে গণমাধ্যমে কাজ করতে যাচ্ছে, তারা যথেষ্ট প্রস্তুত নয় বলে কিছু ক্ষেত্রে চাকরিদাতারা অসন্তোষ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে আপনার মূল্যায়ন কী?

উত্তর : দেশে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা নিয়ে পড়াশোনার হার বাড়ছে। পাশাপাশি এটাও সত্য যে, চাকরিদাতাদের অসন্তোষ আছে। কেন এই অসন্তোষ- এ প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গেলে কিছু বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা জরুরি; যেমন : বাংলাদেশে সাংবাদিকতায় পাঠদান শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬২ সালে। আমার জানা মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে আজ অবধি কোনো মিডিয়া ল্যাব তৈরি হয়নি। ১৯৬২ সালে স্থাপিত এই বিভাগ যা পারেনি, তা অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আশাই করা যায় না। অবশ্য এখন কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক মিডিয়া ল্যাব আছে যা শিক্ষার্থীদের প্রায়োগিক জ্ঞান চর্চায় সহায়তা করছে। তবে বর্তমানের মিডিয়া জগত যেখানে ওয়েব ৪.০-এ প্রবেশের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে, সেখানে দেশের বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে মিডিয়া ল্যাবের শূন্যতা সাংবাদিকতা শিক্ষার বেহাল দশারই প্রতিফলন। ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীরা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল সাংবাদিকতার জগত সম্পর্কে খুব কম বাস্তব জ্ঞান নিয়েই শিক্ষাজীবন শেষ করে। এখানে আমি বলছি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পরিবর্তনশীল ও প্রযুক্তিনির্ভর এই পেশাকে জানার সুয়োগ শিক্ষার্থীদের খুব বেশি হয়ে ওঠে না। ফলে চাকরিদাতাদের অসন্তোষ তৈরি হয়।

তবে এক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় মাথায় রাখা জরুরি যে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ কিন্তু সাংবাদিক গড়ে তোলার মূলমন্ত্র সামনে রেখে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। যেমন- আমি যেখানে শিক্ষকতা করি, সেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার তত্ত্বীয় আলোচনাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিভাগ সাংবাদিকতার পরিবর্তনশীল জগত সম্পর্কে শিক্ষাথীদের হাতেখড়ি দিয়ে অভিজ্ঞ করে তুলবে- এমন আশা করাও যাবে না ।

তদুপরি, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ঘাটতি রয়েছে যা পাঠদানে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কারণ, সাংবাদিকতায় কৌশল ও বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান - দুটোই জরুরি। এই দুটি বিষয়ের সমন্বয়েই সাংবাদিকতা এগিয়ে চলে। আর কৌশলগত জ্ঞানের জন্য প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তিবান্ধব অবকাঠামো। এই প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত উন্নততর হচ্ছে। সেখানে যদি বিভাগগুলো হালনাগাদ অবস্থায় না থাকে, তাহলে চাকরিদাতারা অসন্তুষ্ট হতেই পারেন।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সাংবাদিকতা বিষয়ের পাঠ্যসূচি গণমাধ্যমের বর্তমান চর্চার সঙ্গে কতোটা সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের পড়ায় পুরোপুরি অ্যাকাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। তাদের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে বিদ্বান করে তোলাই প্রধান কাজ। এর পাশাপাশি প্রায়োগিক ক্ষেত্রগুলোতে জ্ঞান ও চর্চা নিশ্চিত করা হয়। এরপরও একজন শিক্ষার্থী যখন কাজে যোগ দেয় তখন তার প্রয়োজন হয় প্রশিক্ষণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ প্রশিক্ষণের সুযোগের স্বল্পতা রয়েছে।

আর প্রতিনিয়ত সাংবাদিকতার ধরন ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তন হচ্ছে। তাই যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতিনিয়ত সিলেবাস আপগ্রেড করা খুব দরকার। বিভাগগুলোর অ্যাকাডেমিক কমিটিসহ সিলেবাসের দায়িত্বে থাকা সবাই বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেন। এ কারণে সময়ের প্রযোজনে বিভাগগুলোতে অনলাইন জার্নালিজম, সিটিজেন জার্নালিজম, মোজো বা মোবাইল জার্নালিজম - এসব নতুন নতুন বিষয় প্রতিনিয়ত সংযোজিত হচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এনভায়রনমেন্টাল জার্নালিজম, সায়েন্স রিপোর্টিং, কনফ্লিক্ট জার্নালিজমের মতো কোর্স চালু হয়েছে। আবার প্রতিটি বিভাগ তার বিশেষায়িত চাহিদা অনুসারে নতুন কোর্স যুক্ত করে। পাশাপাশি শিক্ষকরা প্রতিনিয়ত তাদের কোর্সগুলো আপডেট করেন।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে গণমাধ্যমের সমন্বয় আরও বাড়ানো যায় কীভাবে?

উত্তর : বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য মিডিয়া হাউজগুলো নতুন নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে থাকে। আর এসব ধারণার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরিচয় করানোর জন্য বিভাগগুলো গণমাধ্যমের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পারে। পাশাপাশি সেমিনার-সিম্পোজিয়াম করার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান হওয়া সম্ভব। ফলে শিক্ষার্থীরা যে-কোন গণমাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে ‘কালচারালি শকড’ হওয়ার আশঙ্কা থাকবে না। বিভাগগুলোতে অবশ্য ‘ইন্টার্নশিপ’-এর ব্যবস্থা আছে; তবে প্রযোজনে এর পরিধি আরও বাড়ানো যায়।

প্রশ্ন : বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার জন্যে সাংবাদিকতা এখনো খুব বেশি পছন্দের বিষয় হতে পারেনি। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?

উত্তর : আমি মনে করি এই বিষয়ের সঙ্গে ‘কালচারাল মাইন্ডসেট যুক্ত আছে। আমাদের সমাজ খুব কম পেশাকে ‘গ্রহণযোগ্য’তকমা প্রদান করে। পাশাপাশি বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে চাকরি পাওয়া ও এর স্থায়িত্ব এখনো অনিশ্চয়তার সঙ্কটে আবদ্ধ। এছাড়া সাংবাদিকতা একটি দায়িত্বশীল পেশা; সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বোধ থেকেই মানুষ এ পেশা বেছে নেয়। ফলে যারা পেশাজীবনকে ভিন্নভাবে দেখে এবং স্বস্তিদায়ক ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ একটি চাকরি বা ব্যবসাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায়, তাদের মধ্যে এ পেশায় আসার আগ্রহ কম। এ কারণে তারা পড়ার জন্যেও অন্য বিষয়কে বেছে নেয়।

তবে বাংলাদেশে মিডিয়া মার্কেট বড় হচ্ছে; বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা আগের চেয়ে বেড়েছে। এ পেশা নিয়ে আগে মানুষের মনে যে অনাস্থা ছিলো, সেটিও বদলে যাচ্ছে। ফলে খুব ধীরে হলেও এ পেশার প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিষয় হিসেবে সাংবাদিকতার ব্যাপারে আগ্রহ বাড়ছে। গত এক দশকে অনেকগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ খোলাই এর প্রমাণ।

এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট সবাই যদি ব্যক্তিগত স্বার্থচিন্তার ঊর্ধ্বে উঠে সাংবাদিকতায় পেশাগত সুরক্ষা ও মর্যাদার বিষয়টিকে নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখেন, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে পড়ার বিষয় হিসেবে সাংবাদিকতা অন্যতম আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠবে বলে আমার বিশ্বাস।

প্রশ্ন : যারা সাংবাদিকতা বিষয়ে পড়াশোনা করছে এবং ভবিষ্যতে সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিতে চায়, তাদের প্রতি আপনার কোনো পরামর্শ বা দিকনির্দেশনা?

উত্তর : ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ এডমুন্ড বার্ক ১৭৮৭ সালে হাউস অব কমন্স-এ তাঁর বক্তব্যে সংবাদমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছিলেন, এটি অন্য তিনটি স্তম্ভের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, একজন সৎ, নির্ভীক ও নিরপেক্ষ সাংবাদিক সমাজের কাছে যেমন সমাদৃত, তেমনি সমাজবিরোধীদের কাছে আতঙ্ক।

বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতাই একজন সাংবাদিককে সমাজের কাছে গ্রহণয্যেগ্য করে তুলতে পারে। তাই ভালো সাংবাদিক হতে হলে নিয়মিত সংবাদ বিষয়ক বই ও পত্রিকা পড়তে হবে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ওপর লেখা বইপত্র সংগ্রহ করে তা নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। সাংবাদিক হতে চাইলে জানার পরিধি বিস্তৃত রাখা জরুরি কারণ এর ব্যাপকতা ও বিস্তৃতি গভীর। অনেক বিষয়ের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে এই বিভাগটি। পাবলিক রিলেশনস বা জনসংযোগ, অ্যাডভার্টাইজিং বা বিজ্ঞাপনবিদ্যা, রেডিও, টেলিভিশন, ফিল্ম, ভিডিওগ্রাফি, ফটোগ্রাফি, ফোক মিডিয়া বা লোক মাধ্যম, ইন্টারনেট এবং যোগাযোগসহ আরও নানা বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত। তাই একজন সাংবাদিককে বলা হয় ‘Jack of all trades’।

পাশাপাশি ভাষাগত দক্ষতা, অনুসন্ধানী মনোভাব, যোগাযোগের দক্ষতা, লেখালেখির দক্ষতা, বিশ্লেষণী ক্ষমতার চর্চা করতে হবে। এভাবে পর্যাপ্ত অনুশীলন, প্রশিক্ষণ ও আগ্রহ একজনকে ভাল সাংবাদিক হিসেবে তৈরি করতে পারে যিনি পরবর্তী সময়ে জাতির বিবেক হিসেবে অভিহিত হন।