Media School

Dhaka    Saturday, 20 April 2024

By সজীব সরকার

মানুষ : একটি দার্শনিক বিচার - ২

Media School March 2, 2021

চীনের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক মেনসিয়াস (৩৭২-২৮৯ খ্রিস্টপূর্ব/৩৮৫-৩০৩ খ্রিস্টপূর্ব) কেবল কনফুশাসের দর্শনের অনুসারীই ছিলেন না, কনফুশাসের দর্শনকে তিনি বিস্তৃত ও উন্নততর করে তুলেছেন। মানুষ সম্পর্কে কনফুশাসের মতো মেনসিয়াসের ধারণাও একইরকম ইতিবাচক ও আশাবাদী ছিলো। তিনিও বিশ্বাস করতেন, মানুষ সহজাতভাবেই ভালো এবং জ্ঞান আর ন্যায়পরায়নতার প্রতি ঝোঁক মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি, তবে মানুষের ভেতরকার এই ভালোত্বকে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত করে তুলতে চর্চা ও সঠিক পরিবেশের দরকার। কনফুশাসের দর্শন অনুসারে চীনের নানা অঞ্চলের শাসকদের তিনি প্রজাবর্গের পক্ষে হিতৈষী হয়ে উঠতে পরামর্শ দিতেন। অর্থাৎ উন্নততর ও মহত্তর মানুষ হয়ে ওঠাকেই মেনসিয়াস মানুষের জীবনের লক্ষ্য হিসেবে দেখেছেন।

এক্ষেত্রে কনফুশাসের দর্শনের সাথে চীনের তাওবাদের মিল পাওয়া যায়। কালান্তরে একটি ঐতিহ্যবাহী ধর্ম হয়ে ওঠা তাওবাদের মূল বিষয় হলো ঘটনার স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি, মহাবিশ্ব ও প্রকৃতির শৃঙ্খলা এবং এর স্বাভাবিক পরিণতি। তাও দর্শনের নৈতিক ভিত্তি এর অনুসারীভেদে বিভিন্নভাবে চর্চিত হয়। তবে সাধারণভাবে এই দর্শনে মহাবিশ্বের শৃঙ্খলার মধ্যে স্বাভাবিকতা, সরলতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা এবং সহানুভূতি, সংযম ও বিনয় - এই ‘ত্রিধনকে’ গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এই মতবাদের মূল কথা হলো, মানুষকে হতে হবে বিনয়ী।

তবে কনুফশাসের দর্শনের সাথে তাও দর্শনের একটা জায়গায় পার্থক্য রয়েছে; কনফুশাসের দর্শনে মনে করা হয়েছে, সামষ্টিক (সামাজিক) কল্যাণে ভূমিকা রাখা মানুষের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে কিন্তু তাও দর্শন মনে করে, এমন কোনো উদ্দেশ্যে মানুষের কোনো ভূমিকা রাখার চেষ্টা না করে বরং মহাবিশ্ব ও প্রকৃতির পথ অনুসরণ করে চলাই মানুষের জন্যে মঙ্গলজনক। এর কারণ হিসেবে তাও দর্শনে বলা হয়েছে, মহাবিশ্বের গতিপ্রকৃতি মানুষের একেবারেই অজানা এবং তা জানা মানুষের সাধ্যের বাইরে। ফলে এখানে সুনির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্যে কিছু করতে গেলে বরং এতে বিপত্তিই ঘটবার আশঙ্কা রয়েছে; এর চেয়ে বরং সবকিছুকে প্রকৃতির নিয়মেই চলতে দেয়া উচিত। তাও দর্শনের এই জায়গাটিতে প্রাচীন সনাতন ধর্মের ‘নিষ্কাম কর্মের’ ধারণার কিছুটা সাযুজ্য রয়েছে। নিষ্কাম কর্মের দর্শন হলো, কোনোরূপ ফলের আশা না করে যা ধর্মসিদ্ধ, সেভাবে কাজ করে যাওয়া।

ইংরেজ দার্শনিক থমাস হবস (১৫৮৮-১৬৭৯) অবশ্য মানুষ সম্পর্কে নিরাশাবাদীই ছিলেন। তাঁর বিচারে মানুষ উদ্ধত, অহংকারী ও আত্মশ্লাঘাপূর্ণ সত্তা। হবসের বিচারে মানুষ স্বার্থপর; সে অন্যকে শাসন-শোষণ করতে চায় এবং অন্যের কাছ থেকে সম্মান আদায় করতে চায়। হবসের ভাবনায় মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হলো হিংস্রতায় পরিপূর্ণ এবং মানুষের জীবন তাই মূলত একাকী, শোচনীয়, সহিংস ও সংক্ষিপ্ত। হবসের দৃষ্টিতে সমগ্র মানবজাতির প্রত্যেকেই একে অন্যের সাথে একরকমের ‘যুদ্ধে লিপ্ত’।

হবসের এই ধারণা অনেক দার্শনিকের কাছে নেতিবাচকতার দোষ্টে দুষ্ট হলেও এখানে মানুষের কিছুটা অস্তিত্ববাদী বৈশিষ্ট্যের প্রমাণ রয়েছে; ফরাসি দার্শনিক জাক দেরিদা (১৯৩০-২০০৪) একে ‘মনুষ্যসুলভ’ বৈশিষ্ট্য বলেই বিবেচনা করেছেন। অবশ্য মানুষের জীবনে দেরিদা অভিজ্ঞতাকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে দেখেছেন। একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, দেরিদার চিন্তাজগতে মার্ক্সবাদ, অস্তিত্ববাদ, ধ্রুপদী জার্মান ভাববাদ, জ্যঁ-পল সার্ত্র, আলবেয়ার কামু, মিশেল ফুকো ও ফ্রেডরিখ নীৎশের দর্শন এবং উত্তরাধুনিক সাহিত্য সমালোচনার কম-বেশি প্রভাব ছিলো। ফলে দেরিদার মনোজগতে এই বহুমুখী মিশ্রণের প্রভাব তাঁর দার্শনিক ভাবনার জগতেও অনিবার্যভাবে পড়েছে।

হবসের এই বক্তব্যের সমর্থন কেবল দেরিদা নয়, অস্তিত্ববাদী আরেক ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ-পল সার্ত্রের (১৯০৫-১৯৮০) ধারণাতেও উপস্থিত। সার্ত্র বিশ্বাস করতেন, মানুষের অস্তিত্ব আসলে একটি দৈব ঘটনা (চান্স বা অ্যাকসিডেন্ট)। তাঁর মতে, স্বাধীন ইচ্ছেসৃষ্ট ঘটনার বাইরে মানুষের জীবনের কোনো অর্থ বা উদ্দেশ্য নেই আর তাই মানুষকে তার জন্যে সহজলভ্য সম্বলের ওপর নির্ভর করেই বাঁচতে হবে। এখানে আরেকটি বিষয়ে হবসের সাথে সার্ত্রের মিল পাওয়া যায় : হবস যেমন ভেবেছেন মানুষ নিরাশাবাদী ও বিষণ্ণ, সার্ত্রও তেমনি মানুষের এই স্বাধীনতার (স্বাধীন ইচ্ছে বা ইচ্ছের স্বাধীনতা) সঙ্গে উৎকলিকা অর্থাৎ উদ্বেগকে অবিচ্ছেদ্য মনে করেছেন।

সার্ত্র অবশ্য মানুষের জীবনের সাথে তার স্বাধীন ইচ্ছের সাংঘর্ষিকতাকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেছেন। সার্ত্রের মতে, পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব তার নিজের ইচ্ছেয় ঘটেনি। তবে জীবনযাপনের নানা ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। সার্ত্রের বক্তব্য হলো, মানুষ স্বাধীনভাবে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে আবার এই সক্ষমতার জন্যেই তাকে একরকমের দোষী করা হয় যদিও এই পৃথিবীতে মানুষের আগমনটিই তার নিজের ইচ্ছেয় হয়নি। আর এজন্যেই বরং সার্ত্র মনে করেছেন, মানুষকে নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নিয়েই টিকে থাকতে হয়।

হবসের ধারণার বিপরীতে ফরাসি দার্শনিক জ্যঁ জাক রুশো (১৭১২-১৭৭৮) মানুষ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করতেন। মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে কনফুশাসের ধারণার সঙ্গে রুশোর ধারণার মিল রয়েছে। রুশোর বিচারে মানুষের সহজাত প্রকৃতি আসলে ইতিবাচক। রুশোর মতে, দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের কারণে মানুষ চেতনাসম্পন্ন অন্যান্য সত্তা থেকে আলাদা : এক. স্বাধীনতা, এবং দুই. পরিপূর্ণতা অর্জনের সম্ভাবনা। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে মানুষের জীবন ও জীবনের গতিপ্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর বরং নেতিবাচক ধারণা ছিলো; তিনি মনে করতেন, প্রকৃতির মানুষ বা মানুষের আদিম প্রবৃত্তি আদতে নিষ্পাপ-নিষ্কলুষ ছিলো কিন্তু সভ্যতার অস্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি মানুষকে ক্রমেই কলুষিত করে তুলেছে। রুশোর এই ধারণার সঙ্গে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট (১৭২৪-১৮০৪)-এর ধারণার কিছু মিল পাওয়া যায়; কান্টও বিশ্বাস করতেন, মানুষ ইতিহাস ও সংস্কৃতি দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত।

কান্ট অবশ্য মানুষের অস্তিত্ব সম্পর্কে কনফুশসাসের বিপরীত ধারণা রাখতেন। কনফুশাসের মতো কান্ট মানুষকে কোনো দৈব শক্তি বা ঘটনার অধীন বা এর প্রভাবে প্রভাবিত সত্তা হিসেবে দেখেননি; কান্টের বিচারে মানুষ বরং একটি জৈবিক সত্তা। কান্টের বিশ্বাস, মানুষের স্বভাবের ওপর তার জৈবিক বৃত্তিগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি। সে বিচারে দেখা যায়, মানুষ সম্পর্কে কান্টের ভাবনায় নৃতত্ত্বের প্রভাব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। অবশ্য জৈবিকতার পাশাপাশি কান্ট মানুষের জীবনে তার পরিপার্শ্ব, সামাজিকীকরণ ও সংস্কৃতিকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছেন। তবে কান্ট বিশ্বাস করতেন, মানুষের জীবনে কম-বেশি প্রভাব রাখলেও এর কোনোটিই মানুষের মৌলিক ব্যক্তিসত্তার নির্ধারক নয়। কেননা বাহ্যিক এসব চলকের প্রভাব ব্যক্তির জীবন বা মানসে স্থায়ী কিনা, কান্টের বিচারে তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত নয়।

এই বিচারে মানুষ ও মানবস্বভাব সম্বন্ধে কান্টের ধারণা বা বক্তব্য নীতিশাস্ত্রেরই অনুগামী; নৈতিকতাই শেষ পর্যন্ত মানুষকে বিচারের চূড়ান্ত মানদণ্ড। নৈতিকতার ছায়াতলে দায়িত্ব এবং কৃত্য বা বাধ্যতাধকতা এখানে মানুষকে বিচারের গুরুত্বপূর্ণ দুটি চলক। তবে এখানে উল্লেখ্য, নীতিশাস্ত্রের এই শাখায় (ডিঅন্টোলজিক্যাল মোরাল থিওরি) ঠিক বা ভুল কর্ম এখানে এর পরিণতির দ্বারা নিধারিত হয় না; বরং দায়িত্ব সম্পাদনের ভিত্তিতেই তা নির্ধারণযোগ্য। মোদ্দা কথা, কান্টের দর্শনে যুক্তি (রিজন বা র‌্যাশনালিটি), শিক্ষা (এজুকেশন) ও নৈতিকতা (মোরালিটি) হলো মানুষের পক্ষে ‘মানুষ হয়ে ওঠার’ মূল ভিত্তি।

জার্মান চিন্তক কার্ল মার্ক্স (১৮১৮-১৮৮৩) মানুষকে প্রাকৃতিক জীব হিসেবে বিবেচনা করেছেন। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতিজাত প্রাণশীল সত্তা হওয়ার কারণে মানুষ সহজাতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্রাকৃতিক ক্ষমতা ও দক্ষতার অধিকারী।

চলবে...