Media School

Dhaka    Monday, 06 May 2024

By রাজীব সরকার

যত কাণ্ড করোনাকাণ্ডে

Media School June 22, 2020

গোপাল ভাঁড়ের একটি পরিচিত গল্প মনে পড়ছে। গোপালের একটি গরু হারিয়ে গিয়েছিল। চৈত্রের কাঠফাটা রোদে বনে বাদাড়ে সারাদিন খুঁজেও গরু পেলেন না। খুব ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসে নিজের ছেলেকে গোপাল বললেন, “ভাইরে, তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি একগ্লাস জল দাও।” গোপালের স্ত্রী রান্নাঘরে ছিলেন। স্বামীর কথা শুনে তিনি বললেন, “তোমার এত বয়স হলো, অথচ একটু কাণ্ডজ্ঞান যদি থাকতো। নিজের ছেলেকে কেউ ভাই ডাকে?” স্ত্রীর তিরস্কারে একটুও বিচলিত হলেন না গোপাল। সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন স্ত্রীকে- “সাধের গরু হারালে এমনই হয় মা!”

গল্পের মর্মার্থ হচ্ছে, বিপদে পড়লে মানুষ কাণ্ডজ্ঞান হারায়। করোনার দিনগুলিতে এটি আরও বেশি স্পষ্ট হয়ে ওঠেছে। করোনাকাণ্ড অনেক ক্ষেত্রে আক্রমণ করেছে। সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে কাণ্ডজ্ঞান। করোনার প্রাথমিক ধাক্কা সামলে উঠার জন্য যখন সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলো তখন দলেবলে মানুষ কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ‘সামাজিক দূরত্ব’ বলতে তারা নিশ্চয়ই ঘরের সঙ্গে দূরত্ব রক্ষাকে বুঝেছিলেন। ঘর হতে শুধু দুই পা নয়, অজস্র পা ফেলিয়া তারা কক্সবাজারে চলে গেলেন। প্রশাসনকে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদেরকে ঘরমুখী করার জন্য।

লকডাউনের সময় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য ফার্মেসিগুলো খোলা রাখা হয়েছে। যেন রোগীরা প্রয়োজনীয় ঔষধপত্র কিনতে পারেন। ঘরবিমুখ মানুষ এটিকে সুযোগ হিসেবে নিয়েছে। পকেটে প্যারাসিটামল, নাপা এমনকি জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী নিয়ে ঘুরে বেরিয়েছেন দিনের পর দিন। বেচারা পুলিশের সাধ্য কী যে তাদেরকে আটকায়। কাণ্ডজ্ঞানের অভাব থাকলেও জ্ঞানের অভাব নেই কোনো কোনো এলাকাবাসীর। বরাবরের মতোই তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মারামারি, লাঠালাঠি করেছেন তারা। কেউ কেউ বলেছেন, মারামারির আগে ও পরে তারা অস্ত্রশস্ত্রে স্যানিটাইজার লাগিয়েছেন এবং বাড়ি ফিরে গোসল করেছেন। কলহপ্রিয় হলেও তারা যে স্বাস্থ্যসচেতন এবং এ সংক্রান্ত জ্ঞানের অধিকারী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রবাদ আছে- কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ। করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র চিকিৎসক। অনেক চিকিৎসক জীবন বাজি রেখে রোগীদের সেবা করে যাচ্ছেন। উল্টো চিত্রও রয়েছে। যেমন সিলেটের এক গাইনী চিকিৎসক নিজের ফি বাড়িয়েছেন করোনার সময়ে। এমন একজন ফি বাড়ানো চিকিৎসকের কাছে নিজের করোনা আছে কিনা তা পরীক্ষা করতে গেছেন এক রোগী। ডাক্তার তার কাছে পাঁচ হাজার টাকা দাবি করলেন। সেই রোগী ডাক্তারের মুখের উপর হাঁচি দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেল। আতঙ্কিত ডাক্তার নিজের করোনা টেস্ট করে নিলেন। দুদিন পর রোগী সেই ডাক্তারের চেম্বারে ফোন করে জানতে চাইলেন, ডাক্তার কি কোয়ারেন্টিনে আছেন না রোগী দেখছেন। ডাক্তারের সহকারী জানালেন ডাক্তার সুস্থ আছেন এবং চেম্বার করছেন। ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত হলেন- যাক ডাক্তার নেগেটিভ মানে আমিও নেগেটিভ।

করোনাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের বিরল দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন এক ব্যক্তি। কক্সবাজারের এই বাসিন্দা তার এক বন্ধুর কাছে টাকা পেতেন। দীর্ঘদিন তাগাদার পরও বন্ধু টাকা ফেরত দেয়নি। অগত্যা পাওনাদার সেই দেনাদারের বাড়িতে হাজির হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরেন। করোনা রোগীর অনাকাঙ্ক্ষিত আলিঙ্গনে মানসিকভাবে সেই দেনাদার ভেঙ্গে পড়েছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। মানুষ দেখলেই তিনি দূরে চলে যাচ্ছেন। গতিদানব ট্রাকের পেছনে যে লেখাটি দেখতে আমরা অভ্যস্ত ছিলাম, এখন সেটি মানুষের পেছনে লেখার সময় এসেছে : দূরত্ব বজায় রাখুন।

আক্কেল শব্দের আভিধানিক অর্থ বিবেক, কাণ্ডজ্ঞান। জয়পুরহাটের আক্কেলপুরে বিচিত্র আক্কেলের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে আইসোলেশন ইউনিটে আক্রান্ত রোগীর কাছে চিকিৎসক ও নার্স ছাড়া কেউ যেতে পারেন না। কিন্তু আক্কেলপুরের এক ব্যক্তি এই নিয়ম মানেননি। সকল বাধা তুচ্ছ করে তিনি জোর করে আইসোলেশন ইউনিটে আক্রান্ত স্ত্রীর সঙ্গে থেকেছেন। এখানেই শেষ নয়, আক্কেলগুড়ুম হওয়ার মতো আরেকটি ঘটনা ঘটেছে আক্কেলপুরে। আইসোলেশন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় ভর্তি থাকা তরুণী তৃতীয় তলায় আক্রান্ত যুবকের প্রেমে পড়েছেন। তাদেরকে এখানে রাখা হয়েছিল করোনা ভাইরাসের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য। সবার নিষেধ অমান্য করে আক্রান্ত তরুণ-তরুণী দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। সকল বাধা তুচ্ছ করে তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। বাংলা সিনেমার নাম সত্যিই সার্থক- প্রেম মানে না বাধা।

করোনাকাণ্ডের বিচিত্র প্রভাব শুধু বাইরে নয়, ঘরেও পড়েছে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ঘটনা স্বামী-স্ত্রীকে এতদিন এত কাছে এবং প্রেমিক-প্রেমিকাকে দূরে রাখতে পেরেছে। গৃহবন্দী পুরুষের উপলব্ধি- করোনাকে ভয় পাওয়া যাবে না, করোনার সাথে লড়াই করতে হবে। স্ত্রীর সাথে লড়াই করা যাবে না, তাকে ভয় পেতে হবে। এই দুটিকে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। কারণ করোনা ও স্ত্রী - কোনোটিরই ঔষধ আবিষ্কৃত হয়নি। আর গৃহস্থালি কর্মে পুরুষদের অঘটনঘটনপটিয়সী প্রতিভা দেখে স্ত্রীজাতির উপলব্ধি- স্বামী ছাড়া তবু চলে, কিন্তু গৃহকর্মী ছাড়া চলে না।

শপিংমল বন্ধ থাকার ঘোষণায় স্বামী যত খুশি, স্ত্রী তত বিমর্ষ। হঠাৎ ঘোষণা এলো, সীমিত পরিসরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শপিংমল খোলা থাকবে। স্ত্রীগণ তখন খুশি আর স্বামী বেচারাগণ হতাশ। অবশ্য এক রসিক ব্যক্তি স্ত্রী জাতিকে সাবধান করে বলেন, যেসব স্বামী টাকা দিয়ে স্ত্রীদেরকে করোনার ঝুঁকিতে মার্কেটে পাঠাচ্ছেন, তাদের উদ্দেশ্য আগামী বছরের ঈদে নতুন স্ত্রীকে নিয়ে শপিং করা। লকডাউন পুরুষ সম্প্রদায়কে অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করেছে। লকআপ মানে পুলিশী হেফাজতে থাকা আর লকডাউন মানে স্ত্রীর হেফাজতে থাকা।

স্ত্রীর হেফাজতে থাকা স্বামীগণ যখন জামিনের প্রহর গুনছেন, তখন পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের এক চাকুরে স্বেচ্ছায় অন্তরীণ হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। লকডাউনের সরকারি নিষেধাজ্ঞা না মেনে তিনি ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গণজমায়েত করে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরেছেন। কর্তৃপক্ষ তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছেন। বিয়ের মতো মহান কর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে চাকরি হারানোর এমন নজির কারো নেই।

লকডাউনের কার্যকারিতা মানুষের কাণ্ডজ্ঞানের সমানুপাতিক। লকডাউন না মেনে বহু মানুষ রাস্তায়, অলি-গলিতে গিজগিজ করছে। এমন যদি হতো যে শোনা গেল এই ভিড়ের মধ্যে করোনা রোগী আছে, তবে সঙ্গে সঙ্গেই পাগলের মতো ছুটে পালাত মানুষ এবং আশ্রয় নিত গৃহকোণে। কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষেরা উল্টো হাওয়ার পন্থী হয়। সরকার যেহেতু ঘরে থাকতে বলেছে, তাই বাইরে ঘোরাঘুরির ঝোঁক তাদের। যদি সরকার বলতো করোনা ভাইরাস থেকে বাঁচতে ঘরের বাইরে অবস্থান করতে হবে, তবে নিশ্চয় তারা দলবেঁধে ঘরে থাকতেন।

রাজীব সরকার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

[লেখাটি দৈনিক সমকাল-এ ২৯ মে ২০২০ প্রকাশিত হয়।]