Media School

Dhaka    Thursday, 02 May 2024

By মিডিয়াস্কুল ডেস্ক

রাজীব সরকারের বিতর্কের প্রথম পাঠ

Media School June 24, 2020

এক হিসাবে জীবনটাই বিতর্ক। কেননা মানব জাতি যখন যা কিছু গ্রহণ বা বর্জন করেছে, এর সবকিছুর মধ্যেই তর্ক-বিতর্ক থাকতে হয়েছে। এভাবে চিন্তাটিতে অবশ্যই বিশদ আলোচনার হাতছানি আছে। ছোট করে যদি ধরি- আমাদের সংসার জীবন, আমাদের চাকরি জীবন, আমাদের ছাত্র জীবন এবং সামাজিক জীবন; এর কোনো কিছুই তর্ক-বিতর্ক ছাড়া অগ্রসর হতে পারে? পারবে? পেরেছে কখনও? তাই বিতর্ক মানব জীবনের এক অপরিহার্য সত্য। এই সত্যকে যারা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন তারা নিজেকেই এড়িয়ে যান। বিতর্কের বিষয়টির সাংস্কৃতির একটা প্রতিষ্ঠা থাকলেও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে আরও মনোযোগী হতে হবে বলেই আমার মনে হয়। আমরা যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সিলেবাসে বিতর্কের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে পারি- তাহলে চিন্তা করার অভ্যেসটি মানুষের মধ্যে আরও দ্রুত প্রসারিত হবে। সে-ই আধুনিক মানুষ- যে চিন্তার মধ্য দিয়ে ছাড়া কোনো কিছুই গ্রহণ বা বর্জন করেন না। সেই চিন্তার প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তা দেখতে পাই বিতর্কের মধ্যে। বিতর্ক নামের এই সাংস্কৃতিক অঙ্গনটির চালিকাশক্তিই হচ্ছে চিন্তা। একজন বিতার্কিক তার প্রতিপক্ষের যুক্তিকে খণ্ডন করতে হলে তাকে ভাবতে হবে। ভেবে ভেবে একটি যৌক্তিক সত্য দেখাতে হবে। এই প্রতিযোগিতা ব্যক্তিকে চোখ-কান খোলা রাখা একজন সচেতন নাগরিক হতে সাহায্য করে। একটি স্কুল ছাত্র যখন ছোটবেলাতেই এই যুক্তি-তর্কের ছোঁয়া নিজের মধ্যে নিতে পারবে- পরবর্তী জীবনে যে কোনো ক্ষেত্রেই তার সফলতার সম্ভাবনা বেশি থাকবে। এবং ঘটেও তাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে ছেলে বা মেয়েটি স্কুলজীবন থেকে বিতর্ক চর্চা করেছে- তার ভবিষ্যৎ সাধারণত অন্যের তুলনায় অনেক উজ্জ্বলই দেখা যায়। কথাগুলো বলা গেল রাজীব সরকারের ‘বিতর্কের প্রথম পাঠ’ বইটি হাতে পেয়ে। রাজীব সরকারের লেখার সঙ্গে পরিচয় প্রায় ১০ বছর আগে থেকেই। প্রবন্ধ এবং রম্য লেখক হিসেবেই সাহিত্য মহলে তার পরিচিতি। কিন্তু এই বইটির লেখক পরিচিতিতে দেখতে পেলাম রাজীব সরকার শুধু একজন লেখকই নন, নামকরা বিতার্কিকও। নিজে বিতার্কিক হওয়ায় বিতর্ক সম্পর্কে এমন অসাধারণ একটি বই লেখা তার পক্ষে সম্ভব হয়েছে। বইয়ের নাম ‘বিতর্কের প্রথম পাঠ’ হলেও পড়লে মনে হয় এটি বিতর্কের সামগ্রিক পাঠ। বইয়ের নাম এবং এর উপস্থাপন অত্যন্ত সাবলীল। বিতর্ক সম্পর্কে প্রায় সব ধারণাই দেয়া হয়েছে এই বইয়ে। সেই অর্থে ‘বিতর্কের প্রথম পাঠ’ নামটি ঠিক বইয়ের সামগ্রীকতার অর্থকে চিহ্নিত করেনি। আমরা শিরোনামগুলোয় দেখতে পাই বিতর্কের সব বিষয় এবং কৌশলই উপস্থিত। সূচিপত্রে রয়েছে : ‘বিতর্কের প্রথম পাঠ’, ‘স্ক্রিপ্ট নির্মাণ ও শারীরিক ভাষা’, কৌশল নির্ধারণ, যুক্তির প্রয়োগ ও খণ্ডন’, ‘বিতর্কে পড়াশোনা ও দলীয় সমন্বয়’, ‘দলনেতার দায়িত্ব’, ‘সনাতনী বিতর্ক: টেলিভিশন বিতর্কের চূড়ান্ত পর্ব বিশ্লেষণ’, ‘সংসদীয় বিতর্ক : গণতন্ত্রের বাতিঘর’, ‘বারোয়ারি বিতর্ক : নান্দনিক প্রতীক’, ‘রম্য বিতর্ক : জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ’, ‘বিজয়ী হওয়ার ৮টি শর্ত’, ‘যতীন সরকার ও আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ : সময়ের শ্রেষ্ঠ বিতার্কিক’, ‘নির্বাচিত ১০০ বিষয়’। সংসদীয় বিতর্কের অংশটি পড়ে মনে হয়েছে- শুধু বিতার্কিকই না সব শ্রেণী-পেশার শিক্ষিত জনগোষ্ঠীরই বিতর্কের পাঠ নেয়া উচিত।


বইয়ে মুখবন্ধে লেখক রাজীব সরকার লিখেছেন- ‘গত আড়াই দশকে এ দেশে গণতন্ত্র ও বিতর্কশিল্প সমান্তরালভাবে বিকশিত হয়েছে। কাকতালীয়ভাবে বিতর্কের সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ সংযোগও এ সময়ে ঘটেছে। এই অভিজ্ঞতায় বলতে পারি, বিতর্ক ও গণতন্ত্রের সম্পর্ক পরিপূরক। কারণ বিতর্কের মূল চেতনা যুক্তিবাদিতা ও পরমতসহিষ্ণুতা। আর গণতন্ত্রের ভিত্তিটিও তাই। সে জন্য শুধু বিতর্কের জন্য বিতর্ক নয়, একটি যুক্তিবাদী তথা গণতান্ত্রিক সমাজ যেন গড়ে উঠে সেই দায়বদ্ধতা থেকে বিতর্ক করেছি এবং এই দায়বদ্ধতা পালনে যারা কাজ করছেন তাদের সহযোদ্ধা হয়েছি। একটি প্রাণবন্ত সমাজের শর্ত মুক্তচিন্তা ও তর্ক। সেই তর্ক যখন যুক্তিসম্মত হয়, তা-ই হয়ে ওঠে বিতর্ক।’

লেখকের এই বক্তব্যই প্রমাণ করে একটি সমাজে বিতর্কের মতো বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ। বইয়ের প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদই প্রয়োজনীয় একজন বিতার্কিকের জন্য যেমন, তেমনই সাধারণ সচেতন নাগরিকের জন্যও।

--- মেহেদী হাসান

বিতর্কের প্রথম পাঠ : রাজীব সরকার, প্রকাশক : ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ।

[লেখাটি দৈনিক যুগান্তর-এ ৫ অক্টোবর ২০১৮ প্রকাশিত হয়।]