Media School

Dhaka    Sunday, 28 April 2024

By রাজীব সরকার

রেনেসাঁসের তীর্থে

Media School June 24, 2020

প্রতীকী ছবি

বিচিত্র্য বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ইউরোপের কীর্তিমান দেশ ইতালি। ফুটবল বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ইতালি ইউরোপের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। প্রথম স্থানটি গ্রিসের। ভাবতে অবাক লাগে, আধুনিক সভ্যতার অন্যতম ধাত্রী এই দুটি দেশ। মাদকদ্রব্য, পতিতাবৃত্তির কারণেও ইতালির নাম আলোচিত। ফিল্মি নয়, বাস্তবের গডফাদার এখানে সক্রিয়। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণে ইতালির কাছে মানবজাতি কৃতজ্ঞ- কনডম আবিষ্কারের কৃতিত্ব এই দেশের। কাচশিল্পে দেশটির খ্যাতি আকাশচুম্বী।

ইতালির অর্জনের অন্যতম দাবিদার ভেনিসে পা রাখলাম দুপুর ১২টায়। যাত্রী বোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। ইংরেজি বর্ণ &-এর মতো আকৃতি। এই খালের এক প্রান্তে সেন্ট মার্ক বেসিন, অন্য প্রান্তে সান্তা লুসিয়া রেলস্টেশন। ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই জলরাশির পাশে অবস্থান নিয়েছে প্রায় ১৭০টি ভবন। এগুলো নির্মিত হয়েছে ত্রয়োদশ থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝে। এই ভবনগুলোকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন পণ্যের দোকান। ভেনিসের ঐতিহ্যসম্পন্ন স্যুভেনির কেনার জন্য পর্যটকদের ভিড় সেখানে। ইতালীয় উচ্চারণে ভেনিস এখানে 'Venei'। অবাক হলাম ব্যবসায়ীদের মধ্যে প্রচুর বাংলাদেশি দেখে। ভাগ্য অন্বেষণে অগণিত বাংলাদেশি এখানে এসেছে। ইউরোপের আর কোনো দেশে এত বাংলাদেশি দেখিনি। ব্যবসা-বাণিজ্যে তাদের অনেকেই বেশ এগিয়ে গেছে। তাদের সঙ্গ উপভোগ করলাম। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন প্রবাসীদের অবদানই আমাদের অর্থনীতিকে সচল রেখেছে।

গ্র্যান্ড ক্যানেলের বয়স এক সহস্রাব্দ। এক অতি প্রাচীন নদী থেকে এর উৎপত্তি দশম শতাব্দীতে। সেই সময় থেকেই ব্যবসায়ীরা এখানে বসবাস শুরু করেন। আদি বাড়িগুলো তাদেরই তৈরি করা। মনে পড়ে গেল শেকসপিয়রের বিখ্যাত নাটক 'মার্চেন্ট অব ভেনিস'-এর কথা। ছোটবেলায় এই নাটক পাঠের মধ্য দিয়েই ভেনিসের সঙ্গে আমার পরিচয়। ব্যবসায়ী আন্টোনিও, ব্যাসানিও, সুদখোর ব্যবসায়ী শাইলক, বুদ্ধিমতী আইনজীবী পোর্শিয়া আমার স্মৃতিতে উঁকি মারে। দৃষ্টি মনোহর গ্র্যান্ড ক্যানেলে ঘুরে বেড়ানোর চমৎকার আয়োজন রয়েছে। ওয়াটার বাস, গনডোলায় চড়ে ঘুরছে অগণিত পর্যটক। মাথার ওপর সূর্যদেবতার প্রখর তাপ। সেদিকে কারও ভ্রূক্ষেপ নেই। গনডোলা নামক ময়ূরপঙ্খীসদৃশ নৌকার একটি রোমান্টিক আবহ রয়েছে। প্রেমিক-প্রেমিকা বা স্বামী-স্ত্রী পরম আবেগে গনডোলায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বাহনটি একাদশ শতাব্দী থেকে প্রচলিত। চালকের পরনে নেভি ব্লু-সাদা স্ট্রাইপের টি শার্ট। চার দশক আগে মুক্তিপ্রাপ্ত জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমা 'দ্য গ্রেট গ্যাম্বলার' এর কথা মনে পড়ল। এই স্থানে রোমান্টিক গনডোলায় চড়ে অমিতাভ-জিনাত আমানের প্রেমদৃশ্য মূর্ত হয়ে উঠেছিল রাহুল দেব বর্মণের কালজয়ী গানে 'দ্য লাফজো কি হ্যায় দিল কি কাহিনী ...।' সেই দৃশ্যে চালকের গায়ে যে পোশাক, আজকের চালকের গায়েও সেই একই পোশাক। অদ্ভুত ঐক্য দুই সময়ের মাঝে। অনৈক্য এখানে যে অমিতাভের মতো আমার কোনো সঙ্গী নেই। পূর্ব পরিচিত এক শ্রীলংকান তরুণী আমাকে উৎসাহিত করেছিল তার সঙ্গে গনডোলায় চড়তে। কিন্তু 'মনে কী দ্বিধা' থাকায় আমার আর চড়া হয়নি এই ঐতিহাসিক যানে।

বৈচিত্র্যময় স্বাদযুক্ত উৎকৃষ্ট আইসক্রিম উৎপাদনের জন্যও ভেনিস খ্যাতিমান। আইসক্রিমের স্বাদ নিতে গিয়ে উপরি পাওনা ইতালি ও ঘানার দুই তরুণীর বন্ধুত্ব লাভ। সেদিনই সন্ধ্যায় একটি পোশাক প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে তাদের মডেল হিসেবে অংশগ্রহণ করার কথা। ভিন্ন সংস্কৃতির দুই তরুণীর সঙ্গে ঘুরে বেড়ালাম ভেনিসের অলিগলিতে। হাঁটতে হাঁটতেই চোখ আটকে গেল এক বিক্রেতার পোস্টার প্রদর্শনীর আয়োজনে। কয়েক দশকের পুরনো বিশ্বখ্যাত ইতালীয় চলচ্চিত্রের ও তারকাদের ছবিসংবলিত পোস্টার। সোফিয়া লরেন, মার্সেলো মাস্ত্রোয়ানি থেকে শুরু করে এ যুগের মনিকা বেলুচ্চি সেখানে উপস্থিত। আমার চোখ আটকে গেল ভিট্টোরিও ডি সিকার 'বাইসাইকেল থিভস' চলচ্চিত্রের পোস্টারে।

এই চলচ্চিত্রের প্রতি আমার দুর্বলতার একটি বিশেষ কারণ রয়েছে। উপমহাদেশীয় তথা বাংলা চলচ্চিত্রের মুক্তিদাতা সত্যজিৎ রায় বিশ্ব চলচ্চিত্রের এই অন্যতম মাস্টারপিস দেখে তার অবিস্মরণীয় কীর্তি 'পথের পাঁচালী' নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান। 'বাইসাইকেল থিভস' চলচ্চিত্রটিকে নিউরিয়ালিজম আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ ফসল বলে গণ্য করা হয়। একজন বেকার যুবক এন্টোনিওকে ঘিরে এই ছবির কাহিনী গড়ে উঠেছে। হতাশ এন্টোনিও দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর একটি চাকরি পায়। তার কাজের জন্য প্রয়োজন একটি সাইকেল। তার কাজ রাস্তায় পোস্টার লাগিয়ে বেড়ানো। সাইকেলটি চুরি যায়, যার অর্থ চাকরি যাওয়া। এন্টোনিও তার ছোট ছেলেটিকে নিয়ে খুঁজে বেড়ায় হারানো সাইকেল। এ সূত্রেই রোমের অন্ত্যজ শ্রেণী, ভবঘুরে, বাজার, রেস্তোরাঁ, বেশ্যালয় ঠাঁই পায় এ ছবিতে। ঠাঁই পায় দুস্থ জীবন থেকে মুক্তির উপায় জানার জন্য গণৎকারের কাছে ভিড়, চার্চের ভণ্ডামি। উপায়ন্তুর না দেখে শেষ পর্যন্ত এন্টোনিও একটি সাইকেল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে ও লাঞ্ছিত হয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত_ চোর বলে লাঞ্ছিত এন্টোনিও আর তার ছেলেটির মধ্যে অপরাধবোধ-লজ্জা-অভিমান মিশ্রিত পাশাপাশি হাঁটা, আবার দু'জন দু'জনকে সহজভাবে ভালোবাসার আকাঙ্ক্ষা। শিল্পে কীভাবে মলিনতার মধ্যে, দুঃসহ জীবনযাত্রার গ্লানির মধ্যে নির্মল মনুষ্যত্বের মহিমা প্রকাশ করা যায়, কত সামান্য পরিসরে সৃষ্টি করা যায় মহৎ শিল্প তা ডি সিকা এ চলচ্চিত্রে সার্থকতার সঙ্গে দেখিয়ে দিলেন। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনে জরাজীর্ণ ভারতীয় বাস্তবতার এই চলচ্চিত্র রূপকল্পনা করার আগে সত্যজিৎ রায় নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থীর মতো 'বাইসাইকেল থিভস' বহুবার দেখেছিলেন। ১৯৪৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই চলচ্চিত্রের সেই সময়ের পোস্টার আমাকে যেন ছয় দশক পেছনে নিয়ে গেল। সহচরী ইতালীয় তরুণী আমার বিস্ময়ের কারণ বুঝতে পারেনি। তাকে বললাম এই চলচ্চিত্র কীভাবে এক বঙ্গসন্তানকে বিশ্বজয়ী চলচ্চিত্রকারে রূপান্তরিত করেছে। ডি সিকার প্রতি সত্যজিতের হয়ে ঋণ স্বীকার করলাম সেই তরুণীর কাছে। তার ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি বুঝিয়ে দিল এজন্য সে গর্বিত।

অন্যান্য ইউরোপীয় শহরের মতো ভেনিসেও ইংরেজি বিদ্বেষ চোখে পড়ল। হোটেলে ফেরার পথে বাস থেকে নামার আগে এক ভদ্রলোক ইতালীয় ভাষায় আমাকে কিছু বললেন_ শরীরী ভাষা দেখে বুঝলাম তার নজর আমার আসনের দিকে। বাস থেকে নামার আগে আসনটি যেন তাকে বুঝিয়ে দিই। এ যেন ঢাকার পাবলিক বাসে চড়ার অভিজ্ঞতা। সুপার মার্কেটে শপিং করতে গিয়েও একই বিপত্তি। রাত ৮টার মধ্যে মার্কেট বন্ধ হয়ে যাবে_ এ কথাটিও বিদেশি পর্যটকদের তারা ইংরেজিতে বলতে অপারগ।

ভেনিস ছেড়ে আজ ফ্লোরেন্সের দিকে চলেছি। মাঝপথে পার হলাম মিলান। রাস্তায় লেখা কতদূরে রয়েছে রোম। এ নামগুলোর সঙ্গে পরিচয় শৈশবে-গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে-সিনেমায়। তখন কি জানতাম এই নামগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ পরিচয়ের সুযোগ ঘটবে একদিন? পাহাড় কেটে দু'পাশে মনোরম প্রাকৃতিক বিন্যাস রেখে কীভাবে একটি মহাসড়ক তৈরি হতে পারে এর আদর্শ উদাহরণ ফ্লোরেন্সের প্রবেশপথ। রেনেসাঁসের জন্মনগরী বলে খ্যাত ফ্লোরেন্সে কী আছে তা দেখার জন্য মুখিয়ে আছি। ইতালির সবচেয়ে ঐশ্বর্যশালিনী নগরী ফ্লোরেন্স একসময় রাজধানী ছিল। রোমান দেবী ফ্লোরার নামে এ নামকরণ।

জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আমি ইউরোপীয় রেনেসাঁসের অনুরাগী। এই রেনেসাঁস বা নবজাগরণের ছোঁয়া লেগেছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতায় ও বিংশ শতাব্দীর ঢাকায়। এ সম্পর্কে বইপত্র বা তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি কখনোই আমার ছিল না। কিন্তু নিজের চোখে রেনেসাঁসের জন্মভূমিকে প্রত্যক্ষ করা এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ফ্লোরেন্স সেই উপহার আমায় দিয়েছে। পঞ্চদশ থেকে প্রায় সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত নবজাগরণের ঢেউ প্লাবিত করে ইউরোপের প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কারকে। মিকেলেঞ্জেলো, বতিচেল্লি, রাফায়েল, ভিঞ্চি, গ্যালিলিও - আরও কত শ্রেষ্ঠ মনীষীর কালজয়ী প্রতিভার উদাহরণ হয়ে আছে ফ্লোরেন্স নগরী! শত শত বছর আগের অপূর্ব স্থাপত্যশৈলী দেখে শ্রদ্ধাবনত হতে হয় এই অমর স্রষ্টা ও তাদের পূর্বসূরিদের প্রতি। মিকেলেঞ্জেলোর 'ডেভিড' 'পিয়েটা', ভিঞ্চির 'মোনালিসা,' 'দ্য লাস্ট সাপার', বতিচেল্লির 'দ্য বার্থ অব ভেনাস' এর প্রভাব শহরের সর্বত্র। 'The Springtime of Renaissance (1400-1620) Florence' নামে এক চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনীর মুখোমুখি হলাম। সেই সময়ের সেরা ভাস্কর্য, চিত্রকর্মের সমাবেশ। ফ্লোরেন্সে শিল্পবোদ্ধাদের জন্য জাদুঘরের অভাব নেই। মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে সেখানে ঢোকার টিকিট কাটছে দেখে খুব ভালো লাগল। রেনেসাঁসের স্রষ্টা ও তাদের সৃষ্টিকর্মের প্রতি দর্শকদের ভালোবাসা অফুরন্ত।

ফ্লোরেন্সের উফিজি গ্যালারিতে পরম যত্নে সংরক্ষিত রয়েছে সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম 'বার্থ অব ভেনাস'। সৌন্দর্য ও প্রেমের অনবদ্য প্রতীক দেবী ভেনাস। ১৪৮২-৮৫ সালের মধ্যে সান্দ্রো বতিচেল্লি এই কালজয়ী চিত্রকর্মটি সম্পন্ন করেন। নগ্ন দেবী সমুদ্র থেকে উঠে আসছেন। তার বাঁ দিকে মৃদু বাতাস গোলাপের সুরভিতে রাঙিয়ে দিচ্ছে স্বর্ণালি কেশরাশি; ডান দিকে আরেক সুন্দরী অপেক্ষমাণ ভেনাসের নগ্ন দেহকে বস্ত্র দিয়ে আচ্ছাদন করার জন্য। এই আচ্ছাদন কি খুব জরুরি? বতিচেল্লি যেন এ প্রশ্নই করেছেন দর্শনার্থীদের? এ প্রশ্নের উত্তর আমি জানি। তবে নিজের ভাষায় নয়, রবীন্দ্রনাথের অনুপম গদ্যে উত্তরটি দেব। 'য়ুরোপযাত্রীর-ডায়েরি'তে রবীন্দ্রনাথ ১৮৯০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর একটি চিত্র প্রদর্শনীর অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন। তখন তাঁর বয়স ঊনত্রিশ এবং তার কন্যা বেলা তখনও শিশু। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,

"সেদিন The French Exhibition-এ একজন বিখ্যাত artist রচিত একটি উলঙ্গ সুন্দরীর ছবি দেখলুম। কী আশ্চর্য সুন্দর! দেখে কিছুতেই তৃপ্তি হয় না। সুন্দর শরীরের চেয়ে সৌন্দর্য পৃথিবীতে কিছু নেই-কিন্তু আমরা ফুল দেখি, লতা দেখি, পাখি দেখি, আর পৃথিবীর সর্বপ্রধান সৌন্দর্য থেকে একেবারে বঞ্চিত। মর্ত্যের চরম সৌন্দর্যের উপর মানুষ স্বহস্তে একটা চির অন্তরাল টেনে দিয়েছে। কিন্তু সেই উলঙ্গ ছবি দেখে যার তিলমাত্র লজ্জা বোধ হয় আমি তাকে সহস্ত ধিক্কার দিই। আমি তো সুতীব্র সৌন্দর্য-আনন্দে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলুম, আমার ইচ্ছে করছিল আমার সকলকে নিয়ে দাঁড়িয়ে এই ছবি উপভোগ করি। বেলা যদি বড়ো হত তাকে পাশে নিয়ে দাঁড়িয়ে আমি এই ছবি দেখতে পারতুম। এই ছবি দেখলে সহসা চৈতন্য হয়-ঈশ্বরের নিজ হস্তে রচিত এক অপূর্ব দৃশ্য-মানুষ একেবারে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং এই চিত্রকর মনুষ্যকৃত সেই অপবিত্র আবরণ উদঘাটন করে সেই দিব্য সৌন্দর্যের একটা আভাস দিয়ে দিলে।"

গোটা ফ্লোরেন্সজুড়ে যে কয়েকটি ভাস্কর্যের অবিকল ছবি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তাদের অন্যতম 'পিয়েটা'। এর নির্মাতা মিকেলেঞ্জেলো। জগদ্বিখ্যাত এই শিল্পী একাধারে ছিলেন স্থপতি, ভাস্কর, চিত্রকর এবং কবি। এই চার বিদ্যায় তাঁর অতুলনীয় প্রতিভা শিল্পবোদ্ধাদের কাছে প্রচণ্ড বিস্ময়। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সে অনন্য সৃষ্টি 'পিয়েটা' সমাপ্ত করেন। ভাস্কর্যটি রোমের সেন্ট পিটর ব্যাজিলিকায় রক্ষিত আছে। এটি তৈরি করার সময় তিনি সগর্বে লিখেছিলেন, "রোমে যে সব ভাস্কর্য আছে তার মধ্যে এটি হবে সবচেয়ে সুন্দর, এ রকম ভাস্কর্য আজকের দিনে কোন জীবিত ওস্তাদ গড়তে পারবে না।" এমন অহঙ্কার মিকেলেঞ্জেলোর মতো মহাশিল্পীকেই মানায়।

ভাস্কর্যটি হচ্ছে মাতা মেরি পা ঝুলিয়ে বসে আছেন, কোলে আড়াআড়ি ক্রুশবিদ্ধ হবার পর তাঁর ছেলে যিশুর মৃতদেহ। তাঁর ডান কোলে যিশুর মাথা। যিশুর ঘাড়ের তলায় মেরির ডান হাত, সেই হাত যিশুর বুকের পাঁজর পর্যন্ত প্রসারিত। যিশুর হাঁটু মেরির কোল পেরিয়ে মেরির বাঁ ঊরুর ওপর দিয়ে মেরির বাঁ দিকে ঝোলানো। যিশুর দেহ এমনভাবে নেতিয়ে পড়েছে যে মনে হয় প্রাণহীন স্থবির শরীরের সমস্ত ভার মেরির কোলে। যিশুর ডান হাত মেরির ডান হাঁটুর সামনে দিয়ে ঝুলে পড়েছে। তাঁর বাঁ হাত নিজের কোমর বরাবর এসে তাঁর কোমরের পাশ দিয়ে মেরির কোলে উঠে মেরির শরীরের বাঁ দিকে পড়ে আছে। মেরি তন্ময় হয়ে সমস্ত পৃথিবী থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রিয় পুত্রের দিকে মুখ নত করে অর্ধমুদ্রিত চোখ রেখে ভাবছেন। কী ভাবছেন তিনি? যিশুর নিয়তিনির্ধারিত জীবন, তাঁর মাতৃত্বের নাটকীয় স্মৃতি, যিশুর মৃত্যু এ রকম হবে বহু আগে তার ভবিষ্যদ্বাণী স্মরণ করে? এমন হৃদয়বিদারক, শোকাচ্ছন্ন, আত্মসমাহিত, সংযত মূর্তি কেউ আগে করেননি। সন্তানের জন্য মায়ের শোকের এমন শৈল্পিক আবেগের প্রকাশ আর কোনো ভাস্কর্যে ঘটেনি, হয়তো ভবিষ্যতেও ঘটবে না।

মিকেলেঞ্জেলোর আরেকটি অমর সৃষ্টি 'ডেভিড'। মাত্র ঊনত্রিশ বছর বয়সে এটি তিনি নির্মাণ করেন। 'ডেভিড' কোথায় স্থাপিত হবে সেই স্থান নির্বাচন করেছিলেন ফিলিপিনো লিপ্পি, বতিচেলি্ল, ভিঞ্চির মতো বিশ্বকাঁপানো শিল্পীরা। ১৫০৪ সালের এপ্রিলে 'ডেভিড'-এর নির্মাণ শেষ হলে তা স্থাপন করা হয় পালাৎসো ভেক্কিওর প্রবেশমুখের সামনের অঙ্গনে। একেবারে রাস্তার ওপরে থাকায় ভাস্কর্যটি বিভিন্ন আক্রমণের শিকার হলো। একটি অযাচিত দুর্ঘটনায় ভাস্কর্যের বাঁ হাত ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়। বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অবশেষে ভাস্কর্যটি ফ্লোরেন্সের আকাডেমিয়া দি বেলে আর্টের গ্যালারিতে রাখা হয় ১৮৭৩ সালে। এখনও সেখানেই আছে। পূর্বের স্থানে ভাস্কর্যের অবিকল রেপ্লিকা রয়েছে। এক বিশাল মূর্তি এই ডেভিড। বেদী বাদ দিয়ে মূর্তিটি সাড়ে ১৩ ফুট উঁচু। ডান পায়ে শরীরের ভার রেখে, বাঁ হাঁটু আলগা করে নগ্ন দেহে দাঁড়িয়ে, বাঁ হাত বুকের কাছে ওপর দিকে মুড়ে তার অবস্থান। কাঁধের ওপর গুলতি ফেলা, ডান হাত ডান ঊরু বরাবর সোজা করে ফেলা, ডান হাতে গুলতির পাথর। অপূর্ব ডেভিড গ্রিক পুরুষোচিত সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা, শরীরের প্রতিটি মাপ নিখুঁত, আদর্শ পুরুষের দেহের মাপ। দারুণ আত্মবিশ্বাসী এই ডেভিড। ডেভিড ছিলেন বালক, কিন্তু তার আকৃতি দানবের। এর ওজন নয় টন অর্থাৎ নয় হাজার কিলোগ্রাম।

ডেভিড ক্ল্যাসিকাল গ্রিক বা রোমান ভাস্কর্যের মতো শান্ত, সমাহিত বা সংযত নয়। শরীর প্রচণ্ড শক্ত সমর্থ, কোথাও এতটুকু মেদ নেই। দাঁড়ানোর ভঙ্গি, শরীরী অভিব্যক্তি, বিস্ফোরিত দৃষ্টি, কোঁচকানো ভ্রূ, ললাটে কুঞ্চিত রেখা - সব কিছু শরীরে ও মনে বেশ আলোড়ন তুলেছে। গুলতিটি কাঁধে এমনভাবে রাখা যে, তিনি যে কোনো সময় গুলতি ছুড়তে সক্ষম। দেহে ও মনে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী ডেভিড এই বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন যে আগামী দিনে তিনিই হবেন ফ্লোরেন্সের শৌর্যবীর্যের প্রতীক।

ফ্লোরেন্স আরনো নদীর ধারে অবস্থিত। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে নদীর দু'পাশের মনোরম প্রকৃতিকে দেখা এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। তখন গোধূলি, গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। কিছুক্ষণ পর রেনেসাঁসের শহর ফ্লোরেন্সের আকাশে পূর্ণ মহিমায় চাঁদ জেগে উঠল। প্রায় পূর্ণিমার আলোয় আরনো নদীর জলে অপূর্ব বিকিরণ। আলোঝলমলে ফ্লোরেন্সের গায়ে অগণিত ভাস্কর্য, সুদৃশ্য ভবন অলঙ্কারের মতো শোভা পাচ্ছে। আলোকের ঝরনাধারায় স্নাত এই শহরের সৌন্দর্য যেন নিংড়ে নিতে ব্যস্ত সবাই। শহরের কেন্দ্রস্থলে কিছুক্ষণ নির্বাক দাঁড়িয়ে রইলাম। অদূরে ভিঞ্চি, ম্যাকিয়াভেলি, গ্যালিলিওর মতো যুগস্রষ্টা মনীষীদের ভাস্কর্য। তাদের কীর্তিধন্য ফ্লোরেন্সে আজ আমার মতো নগণ্য পথিক। বিশ্বাস করতে মন চায় না। রেনেসাঁসের পুণ্যতীর্থে অবগাহনের অভিজ্ঞতায় আমি শিহরিত।

মন না চাইলেও ইতালির মায়া ছাড়তে হয়েছে। শেষ হইয়াও হইলো না শেষ - ছোটগল্পের সংজ্ঞার মতোই এক টুকরো বর্ণিল ইতালি আবার আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকে।

[লেখাটি দৈনিক সমকাল (কালের খেয়া)-এ ২৮ আগস্ট ২০১৫ প্রকাশিত হয়; লেখকের অনুমতিক্রমে পুনঃপ্রকাশিত।]