Media School

Dhaka    Friday, 26 April 2024

By সজীব সরকার

সংবাদ ও সাংবাদিকতার মৌলিক নীতিমালা

Media School July 14, 2020

গণমাধ্যমের নৈতিকতার মূল উদ্দেশ্য হলো সত্য তথ্যের সঠিক পরিবেশনা। ছবি : medium.com

Journalism is the first rough draft of history.
- Philip Graham, Publisher, The Washington Post

প্রতিটি পেশারই নিজস্ব নৈতিক ভিত্তি থাকে; এসব নীতিমালার আলোকে পেশাদাররা নিজেদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত করেন বা অন্তত করবেন বলে তাদের কাছে আশা করা হয়। সংবাদমাধ্যমেরও তেমনি নিজস্ব নীতিমালা রয়েছে। দেশ ও প্রতিষ্ঠানভেদে এ নীতিমালায় কিছু ভিন্নতা থাকলেও এর মধ্যে কিছু সাধারণ বিষয় রয়েছে :

অভিযুক্তের বক্তব্য থাকতে হবে : রিপোর্টে কাউকে অভিযুক্ত করা হলে তাতে অবশ্যই সেই অভিযুক্তের বক্তব্য থাকতে হবে। অভিযুক্তকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেয়া সাংবাদিকতার নীতিমালার পরিপন্থী।

সব পক্ষের বক্তব্য থাকবে : রিপোর্টে বিবদমান একাধিক পক্ষের উল্লেখ থাকলে অবশ্যই সব পক্ষের বক্তব্য সেখানে থাকতে হবে। কোনো এক পক্ষের বক্তব্য থাকবে আর অন্য পক্ষের বক্তব্য থাকবে না - এভাবে রিপোর্ট লেখা যাবে না। সব পক্ষের বক্তব্য ছাড়া একটি প্রতিবেদন সম্পূর্ণ হয় না; তাই রিপোর্টে যেসব পক্ষের উল্লেখ রয়েছে তার সব পক্ষের বক্তব্য তুলে ধরার মাধ্যমে রিপোর্টে ভারসাম্য (balance) আনতে হবে।

সূত্রের উল্লেখ থাকতে হবে : রিপোর্টে ব্যবহৃত প্রতিটি তথ্যের সূত্র (source) উল্লেখ করতে হবে; স্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে তথ্যের সূত্র উল্লেখ করতে না পারলে ওই রিপোর্ট বিশ্বাসযোগ্যতা (credibility) হারায়। তবে কেউ যদি নিজের নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তথ্য দেয়, তবে সেই তথ্যে সূত্রের স্পষ্ট ব্যবহার ঠিক নয়।

একাধিক সূত্র ব্যবহার করতে হবে : রিপোর্ট করার সময় কোনো একটি বিষয়ে একটি মাত্র সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যের ওপর ভরসা করা যাবে না; একাধিক সূত্র থেকে তথ্য যোগাড় করতে হবে। একাধিক সূত্র থেকে তথ্য যোগাড় করলে তথ্যের সত্যতা যাচাই যেমন সম্ভব হয়, তেমনি পাঠকের কাছে ওই প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ে।

তথ্য যাচাই করতে হবে : সংবাদ প্রতিবেদনে কোনো ভুল তথ্য দেয়া যাবে না; এজন্যে এতে উল্লেখ করা প্রতিটি তথ্যের সত্যতা যাচাই করতে হবে।

তথ্য শতভাগ নির্ভুল হতে হবে : রিপোর্টে উল্লেখ করা প্রতিটি তথ্য শতভাগ নির্ভুল ও শুদ্ধ হতে হবে। তাই সংবাদটি প্রকাশ বা প্রচারের আগে প্রতিটি তথ্য বার বার খতিয়ে দেখতে হবে (check & re-check)। কোনো তথ্য নিয়ে মনে সন্দেহ থাকলে বা চেষ্টা করেও বিশ্বাসযোগ্য সূত্রের অভাবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া না গেলে প্রয়োজনে তা বাদ দিতে হবে; কোনো অবস্থাতেই ‘অনুমান’ করে কোনো তথ্য দেয়া যাবে না। সাংবাদিকতায় একটি কথার চল রয়েছে : কোনো তথ্য নিয়ে মনে সন্দেহ থাকলে তা প্রকাশ থেকে বিরত থাকতে হবে (when in doubt, leave it out)।

প্রতিবাদ বা সংশোধনী প্রকাশ : কোনো কারণে ভুল তথ্য প্রকাশিত হয়ে গেলে সেটি নজরে আসামাত্রই নিজ থেকেই এর সংশোধনী প্রকাশ করতে হবে। পত্রিকার ক্ষেত্রে সংশোধনী ছাপার বেলায় একটি পুরোনো প্রথা হলো, পত্রিকার যে পাতায় এবং ঠিক যেখানে ওই সংবাদটি আগে ছাপা হয়েছিলো, ঠিক সেখানেই সংশোধনীটি ছাপতে বলা হয়। প্রকাশিত কোনো সংবাদের যদি কোনো প্রতিবাদ জানানো হয়, তবে সেটিও প্রকাশ করা সাংবাদিকতার নীতি; প্রয়োজনে এতে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা তার প্রতিষ্ঠানের ব্যাখ্যাও যুক্ত করা যেতে পারে। সংশোধনী বা প্রতিবাদ (rejoinder) প্রকাশের মাধ্যমে একটি সংবাদমাধ্যমের নৈতিকতা ও দায়বদ্ধতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ প্রকাশ পায়।

বস্তুনিষ্ঠতা থাকতে হবে : রিপোর্টের প্রতিটি তথ্য ও বক্তব্য বস্তুনিষ্ঠ (ড়নলবপঃরাব) অর্থাৎ সত্য ও নিরপেক্ষ হতে হবে। রিপোর্টে প্রতিবেদকের ব্যক্তিগত কোনো মতামত, বিশ্বাস বা মূল্যবোধের প্রতিফলন (objective) থাকা যাবে না।

ব্যক্তিগত বিরোধ থেকে প্রতিবেদন করা যাবে না : কারো সঙ্গে ব্যক্তিগত বিরোধের সূত্র ধরে তাকে অপদস্থ করতে কোনো রিপোর্ট করা যাবে না অথবা সত্য ঘটনা হলেও সেই রিপোর্টে একই কারণে প্রতিবেদক কোনো ব্যক্তিগত আক্রমণ করতে পারেন না।

ঘটনার সবগুলো দিক তুলে আনতে হবে : সংবাদে সংশ্লিষ্ট ঘটনার সবগুলো দিক তুলে আনতে হবে; কেবল একটি দিক বা দৃষ্টিকোণ (angle or perspective) থেকে সংবাদ লিখলে সেটি অপূর্ণ থেকে যায়।

সংবাদ হবে পক্ষপাতহীন : সংবাদ কোনো অবস্থাতেই একপেশে বা পক্ষপাতদুষ্ট (biased) হবে না; সংবাদে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক বা তার প্রতিষ্ঠানের কোনো পক্ষে অবস্থান সাংবাদিকতার নীতিমালা-বহির্ভূত।

কারো বক্তব্য বিকৃত করা যাবে না : রিপোর্টে কোনো ব্যক্তির বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির বক্তব্য উদ্ধরণ চিহ্নের (“”) মধ্যে হুবহু তুলে ধরতে হবে; উদ্ধৃতির মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন করা যাবে না। অন্যের কোনো বক্তব্যকে নিজের মতো করে এমনভাবে পরিবর্তন বা ব্যাখ্যা করা যাবে না যা মূল বক্তব্যের অর্থের সঙ্গে মেলে না। অন্যের বক্তব্যে কোনো ধরনের বিকৃতি বা অতিরঞ্জন করা যাবে না।

অপপ্রচার বা অপসাংবাদিকতা করা যাবে না : জনজীবনে গণমাধ্যমের প্রভাব অপরিসীম। তাই রিপোর্টের মাধ্যমে কোনো ধরনের ভ্রান্ত, অবৈজ্ঞানিক বা কুসংস্কারমূলক ধারণা বা তথ্যের প্রচার ঘটানো যাবে না; এতে বিরাট জনগোষ্ঠীর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

জেন্ডার সংবেদনশীল হতে হবে : সাংবাদিকদের অবশ্যই জেন্ডার-সংবেদনশীল (gender-sensitive) হতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষ সম্পর্কিত কিছু ছকবদ্ধ (কিন্তু ভ্রান্ত) ধারণা বা বিশ্বাস (stereotype) ও কুসংস্কার প্রচলিত রয়েছে। বাংলা ভাষায় জেন্ডার অসংবেদনশীল (gender-insensitive) অনেক শব্দ রয়েছে; এসব শব্দ-বাক্য-ধারণা পরিহার করতে হবে; রিপোর্টের মাধ্যমে এসব অসংবেদনশীল ধারণা কিংবা এমন কোনো মিথ (myth) পুনরুৎপাদন বা জোরদার (reproduction or reinforcement) করা যাবে না।

যৌন নির্যাতনের ঘটনায় ভিকটিমের পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না : যে-কোনো ধরনের যৌন নির্যাতন বা হয়রানির ক্ষেত্রে ভিকটিমের নাম-পরিচয়-ছবি তার জীবদ্দশায় কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না। এর একটি বড় কারণ হলো, আমাদের সমাজে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় বেশিরভাগ সময় ভিকটিমকেই এজন্যে দায়ী মনে করা হয়; ভিকটিম ও তার পরিবার সমাজে নানাভাবে হেনস্তার শিকার হন। চারপাশের মানুষের নানা কট‚ক্তির কারণে অনেক ক্ষেত্রে ভিকটিম আত্মহত্যা করেছে - এমন নজিরও দেশে কম নয়। তাই এমন সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

শিশুদের প্রতি সংবেদনশীল হতে হবে : শিশুদের মনোজগত একেবারেই আনকোরা থাকে; সমাজের নানা বিপর্যয়, জটিলতা বা কঠোর বাস্তবতা বোঝা কিংবা এসবের সঙ্গে মানিয়ে চলার মতো সক্ষমতা তাদের থাকে না। তাই কোনো সংবাদে শিশুদের সংশ্লিষ্টতা থাকলে সেখানে সর্বোচ্চ সতর্কতা দরকার। কোনো অপরাধের ভিকটিম হলে ওই শিশুর সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা যাবে না- বিশেষ করে তাতে যদি ওই শিশুর মানসিক আঘাত পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ পরিস্থিতিতে কথা যদি বলতেই হয়, তাহলে অবশ্যই ওই শিশুর একজন অভিভাবকের সম্মতিতে এবং তার উপস্থিতিতে সাংবাদিক শিশুটির সঙ্গে কথা বলবেন; প্রয়োজনের একজন শিশুমনোবিদকেও সঙ্গে রাখতে হবে। এ ছাড়া কোনো শিশু যদি অপরাধে জড়িয়ে যায়, তবে সেই ঘটনার সংবাদে শিশুটির নাম-পরিচয়-ছবি প্রকাশ করা যাবে না; কেননা এতে ওই শিশুটি সমাজের চোখে চিরদিনের মতো ‘অপরাধী’ হয়ে যাবে যা তার ভবিষ্যত জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।

সোর্সকে রক্ষা করতে হবে : নাম-পরিচয় প্রকাশিত হলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বোধ করলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কেউ (source) যদি কোনো তথ্য দেয়, তবে সেই প্রতিশ্রুতি অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে সাংবাদিকের ওপর সোর্সের আস্থা রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে, বিশ্বাস বজায় রেখে সোর্সকে ‘ঝুঁকি থেকে রক্ষা’ করতে হবে; সোর্সের পরিচয় প্রকাশে সাংবাদিক বাধ্য নয়।

সূত্রকে সম্মান জানাতে হবে ও সূত্রের সঙ্গে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে : সাংবাদিকদের বলা হয়, সূত্রকে সবসময় সম্মান করতে হবে (always respect the source)। একজন ব্যক্তি (সূত্র) কথা বলার সময় একজন সাংবাদিককে অনেক তথ্যই দিতে পারেন। তবে ক্ষতি বা বিপদের আশঙ্কা থেকে অথবা অন্য কোনো কারণে কোনো সূত্র যদি এর মধ্যে বিশেষ কোনো তথ্য বা বক্তব্য সংবাদের মধ্যে প্রকাশ না করতে অনুরোধ করেন (off the record), তবে সেটি কোনোভাবেই প্রকাশ করা যাবে না।

সোর্সের সঙ্গে পেশাগত দূরত্ব বজায় রাখতে হবে : তথ্য পাওয়ার জন্যে সাংবাদিককে তার সোর্সের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ও স্বাভাবিক সৌজন্য রক্ষা করে চলতে হবে। তবে এ কাজটি করতে গিয়ে যেন সোর্সের সঙ্গে একেবারে অবাধ সখ্য গড়ে না ওঠে যা তার পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেদিকে সজাগ থাকতে হবে। এজন্য সাংবাদিককে অবশ্যই তার সোর্সের সঙ্গে পেশাগত দূরত্বটি (professional distance) বজায় রাখতে হবে। দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক থাকা জরুরি তবে এই সম্পর্ক যেন কখনোই কোনো সংবাদ বা সংবাদ নিয়ে কাজ করার সময় সাংবাদিকের মনোভাবকে অনাকাঙ্ক্ষিত উপায়ে প্রভাবিত না করে।

সত্যের কাছে দায়বদ্ধতা : মনে রাখা দরকার, একজন সাংবাদিক সবার আগে সত্যের কাছে ও পরে তার সংবাদের পাঠকের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন; এর বাইরে কারো কাছেই সাংবাদিক দায়বদ্ধ নন।

সততা, নির্ভুলতা ও পক্ষপাতহীনতা : সততা (honesty), নির্ভুলতা (accuracy) ও পক্ষপাতহীনতা (fairness) - সার্বিকভাবে এই তিন হলো সাংবাদিকতার নীতিমালার মূল ভিত্তি; কোনো অবস্থাতেই এর কোনো একটিরও ব্যত্যয় ঘটানো যাবে না।