Media School

Dhaka    Friday, 26 April 2024

By সজীব সরকার

সংবাদযোগ্যতা

Media School June 16, 2020

প্রতীকী ছবি

চারপাশে চলমান, ঘটমান সবকিছুই মূলত ‘তথ্য’ : সূর্যের আলো, বৃষ্টি, সড়কে গাড়ি চলার শব্দ, ট্রাফিক সিগনালের লাল বা সবুজ বাতি, পদ্মার ভাঙ্গন...। এর মধ্যে সব তথ্য মানুষ জানতে চায় না বা তাদের জানার প্রয়োজন নেই। চারপাশের অসংখ্য তথ্যের মধ্যে কিছু তথ্য রয়েছে যা মানুষ জানতে চায় বা জানা দরকার; এই দরকারি তথ্যগুলো গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

এসবের মধ্যে সেসব তথ্যই পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পায় যেগুলোর সংবাদ হওয়ার মতো উপযুক্ততা বা যোগ্যতা (সংবাদযোগ্যতা) রয়েছে : মানুষ জানতে চায় বা জানা দরকার- এটিই ওই তথ্যের সংবাদ(হওয়ার)-যোগ্যতা। উপর্যুক্ত তথ্যগুলোর মধ্যে ‘পদ্মার ভাঙ্গন’ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা; অনেক মানুষের জীবনের ওপর এই ঘটনার প্রভাব রয়েছে, দেশের নীতি-নির্ধারণী মহলে এই ঘটনা জানার দরকার রয়েছে। তাই বলা যায়, এই ঘটনার সংবাদযোগ্যতা অর্থাৎ সংবাদ হওয়ার যোগ্যতা রয়েছে।

সংবাদযোগ্যতা নির্ধারণ

একটি ঘটনা সংবাদ হিসেবে বিবেচিত হবে কি না, তা নির্ভর করে ওই ঘটনার ফলাফলের ওপর। সংবাদ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যেসব বিষয়ের বিবেচনায় কোনো ঘটনার সংবাদযোগ্যতা নির্ণয় করা যেতে পারে সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হলো :

১. প্রভাব  (impact): ওই ঘটনা কতো মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে? মানুষের জীবনের ওপর ওই প্রভাবের মাত্রা কতটা?

২. নৈকট্য (proximity): পাঠকের কাছাকাছি অবস্থানে ঘটে যাওয়া ঘটনা দূরের কোনো ঘটনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ; ইউরোপের কোনো দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ১০ জনের মৃত্যুর চেয়ে দেশের ভেতরে কোথাও একই ধরনের ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যুর খবর বাংলাদেশের পাঠকের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

৩. সময়োপযোগিতা (timeliness): ঘটে যাওয়া ঘটনাটি যদি অনেক পুরোনো হয়, তবে তা সংবাদযোগ্যতা হারাতে পারে; গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা যদি খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে ঘটে থাকে তবে তার সংবাদ হওয়ার যোগ্যতা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

৪. চল বা রীতি (currency): এটি সময়োপযোগিতার অনেকটাই কাছাকাছি। সমাজে কখনো কখনো এমন কিছু বিষয় থাকে যা একটি সময় ধরে চলমান থাকে (trending issues); বিশেষ কারণে বিশেষ সময়ে এর চল শুরু হয় এবং একটি সময়ে সেই ইস্যুটি হারিয়ে যায়। উদাহরণে বলা যেতে পারে : বাংলা নববর্ষ, ইংরেজি নতুন বছর, ভ্যালেন্টাইনস ডে কিংবা #মিটুমুভমেন্ট - এ ধরনের বিষয় কিছুদিন ধরে চলমান থাকে এবং গণমাধ্যমগুলো এসব বিষয়ে নিয়মিতভাবে সংবাদ প্রকাশ ও প্রচার করতে থাকে।

৫. খ্যাতি (prominence): খ্যাতি অনেক সময় সংবাদ তৈরি করে; খ্যাতিমান ব্যক্তি, বস্তু বা স্থান সংক্রান্ত কোনো তথ্য সংবাদ হয় কারণ সাধারণ মানুষ এগুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী থাকে। যেমন : ভিঞ্চির আঁকা ‘মোনালিসা’ যদি নিলামে ওঠে কিংবা জনপ্রিয় কোনো তারকা যদি কোথাও বেড়াতে যান সেক্ষেত্রে এগুলো সংবাদ হয়।

৬. নতুনত্ব (novelty): নতুন কোনো ঘটনা কিংবা ‘প্রথম’, ‘শেষ’ বা ‘একমাত্র’ বিষয় বা ঘটনা অনেক সময় সংবাদ তৈরি করে। যেমন : কোনো তারকা যদি ঘোষণা দেন ‘এটিই আমার শেষ সিনেমা’ কিংবা কোনো তারকা ক্রিকেটার ঘোষণা দিলেন, ‘এটিই আমার শেষ ম্যাচ, এর পর আর খেলবো না- অবসরে যাবো’। বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট হিসেবে ‘বঙ্গবন্ধু-১’ বিশ্বজুড়েই সংবাদ তৈরি করেছে।

৭. দ্বন্দ্ব (conflict): ঝগড়া, বিবাদ কিংবা দ্বন্দ্ব যে ভাষাতেই বলা হোক, সবসময়ই মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকে। তবে এ দ্বন্দ্ব যে সবসময় সহিংস হতে হবে, তা নয়; মানসিক চাপ বা টেনশন কিংবা উত্তেজনা তৈরি করে- এমন ঘটনাও দ্বন্দ্বের অংশ। এ কারণেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান, বাংলাদেশ-ভারত, ভারত-পাকিস্তান কিংবা আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল খেলা এত মানুষের আগ্রহের কারণ। অন্যদিকে দুই কোরিয়া, সিরিয়া, কাশ্মির কিংবা রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-জাতিসংঘ সংবাদ তৈরি করে।

৮. পাঠক-দর্শক-শ্রোতা (audience): কোনো ঘটনা সংবাদ হবে কি না, তা অনেক সময় এর অডিয়েন্সের ওপরও নির্ভর করে; যেমন : উগান্ডা বা টুভালুর সড়কে দুর্ঘটনায় ৫ জনের মৃত্যুর ঘটনা বাংলাদেশের মানুষের জানার খুব দরকার নেই বা তারা তা জানতে চায় না বলে এসব ঘটনা আমাদের দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। কিন্তু বাংলাদেশের ভেতরে এমনটি ঘটলে তা সংবাদ হয়। আবার ওই দুই দেশের কোথাও দুর্ঘটনায় আহত বা নিহতদের মধ্যে বাংলাদেশি কেউ থাকলে তখন সেটি আমাদের গণমাধ্যমে সংবাদ হয়।

৯. উদ্ভট কিছু (bizarre): উদ্ভট বা অস্বাভাবিক কিংবা অদ্ভুত কোনো ঘটনা বা বিষয় অনেক সময় খবর তৈরি করে; ৩ পা-অলা কিংবা দুই মাথা-অলা মুরগি নিয়ে দেশ-বিদেশের পত্রিকায় অনেক খবর ছাপা হয়েছে।

১০. মানবিক আবেদন (human interest): মানুষের মনকে ছুঁয়ে যায়, তাদের আবেগকে স্পর্শ করে- এমন কোনো ঘটনা নিয়ে মানবিক আবেদন সমৃদ্ধ খবর হয়। কিছু সংবাদ এমন হয় যেখানে এমন কোনো তথ্য, বক্তব্য বা গল্প থাকে যা মানুষের হৃদয়ে নাড়া দেয়; এই উপাদানটিই হলো ‘মানবিক আবেদন’। এ ধরনের সংবাদে প্রায়ই ঘটনার চেয়ে ব্যক্তি বেশি প্রামাণ্য হয়ে ওঠে। ক্ষুধার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ৮ বছরের শিশুর আত্মহত্যা; ডাকাতের গুলিতে বাবার কোলে ঘুমন্ত শিশুর মৃত্যু; ঈদে নতুন জামা কিনে দিতে না পেরে দুই শিশুকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাবার আত্মহত্যা... এ ধরনের অনেক খবর বিভিন্ন সময় দেশের গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। অন্যান্য ঘটনার চেয়ে এসব ঘটনা মানুষের মনকে বেশি পীড়া দেয়, মানুষের মর্মে আঘাত করে। ২০১০ সালে রাজধানীর নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা আগুনে পরিবার-সহায়-সম্বল হারানো রুনা-রত্মা-আসমাকে নিজের ‘তিন কন্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের দায়িত্ব নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা; ‘মা’ হিসেবে প্রথাগত সব আনুষ্ঠানিকতা মেনে তাদের বিয়ের ব্যবস্থা করেন তিনি। এ ঘটনা তখন গোটা দেশ এমনকি দেশের বাইরেও জনমনে আলোড়ন তোলে। এ ধরনের ঘটনা মানুষের আবেগকে জাগ্রত করে বলে এগুলোকে মানবিক আবেদন সমৃদ্ধ সংবাদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এর বাইরে আরও কিছু বিষয় সংবাদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে :

ক. কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত বা নীতি (prejudice of management): গণমাধ্যমের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বা মালিকপক্ষের নীতি বা সিদ্ধান্তের ওপরও অনেক সময় নির্ভর করে কোনো ঘটনা সংবাদ হবে কি না। অনেক সময় দেখা যায়, কর্তৃপক্ষ তার নীতি বা প্রয়োজন অনুযায়ী কোনো ঘটনাকে সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করছে কিংবা সংবাদের তালিকা থেকে বাদ দিচ্ছে।

খ. বিজ্ঞাপনদাতাদের চাপ (pressure from advertisers): সাধারণত বিজ্ঞাপন গণমাধ্যমের আয়ের সবচেয়ে বড় উৎস। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, এসব প্রতিষ্ঠানের অনুরোধ বা চাপে পড়ে তাদের অনেক খবর ছাপতে হয় কিংবা এর উল্টোটাও হতে পারে : বিভিন্ন সময় দেখা যায়, যারা নিয়মিত বড় অঙ্কের অর্থের বিজ্ঞাপন দেয়, গণমাধ্যমগুলো সেসব প্রতিষ্ঠানের নেতিবাচক খবর প্রকাশ না করে বরং চেপে যায়।

গ. পত্রিকার আকার (size of paper): পত্রিকার আকার অর্থাৎ সেটি কি ব্রডশিট (broadsheet) নাকি ট্যাবলয়েড (tabloid)- এর ওপরও কখনো কখনো নির্ভর করে কোনো ঘটনা সংবাদ হবে কি না। সাধারণত ব্রডশিট বা বড় কাগজে ছাপা পত্রিকাগুলো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বস্তুনিষ্ঠভাবে ছাপার চেষ্টা করে। অন্যদিকে তুলনামূলকভাবে ছোট আকারের কাগজে ছাপা ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো প্রায়ই অগুরুত্বপূর্ণ কিন্তু বিশেষ কিছু পাঠকের আগ্রহ থাকতে পারে- এমন ঘটনাগুলো ছাপতে পছন্দ করে।

ঘ. সংবাদের জন্যে বরাদ্দকৃত স্থান (news hole): পত্রিকায় সংবাদের জন্যে বরাদ্দকৃত স্থানের পরিমাণের ওপরও অনেক সময় কোনো ঘটনা সংবাদ হবে কি না তা নির্ভর করে। যেমন : বেশি পৃষ্ঠার পত্রিকায় বেশি সংবাদ ছাপা সম্ভব হয়। পত্রিকার পৃষ্ঠা কম হলে বা বিজ্ঞাপনের পরিমাণ বেশি থাকলে সংবাদ ছাপার জায়গা কমে যায়। স্থান সঙ্কুলান হলে বা বিজ্ঞাপন কম থাকলে অনেক সময় পত্রিকাগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ এমন ঘটনাও ছেপে থাকে অন্য সময়ে যা ছাপতে চায় না।