Media School

Dhaka    Saturday, 20 April 2024

By সজীব সরকার

হিকির গেজেট : ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সংবাদপত্র

Media School June 20, 2020

হিকির বেঙ্গল গেজেট-এর প্রথম পৃষ্ঠা, ৮ এপ্রিল ১৭৮১।

ভারতীয় উপমহাদেশে সংবাদপত্র প্রকাশের প্রথম উদ্যোগ নেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারি উইলিয়াম বোল্টস (১৭৩৮/৪০-১৮০৮)। একসময় কোম্পানির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের পর ১৭৬৮ সালে তিনি এ অঞ্চল থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশের ঘোষণা দেন। তবে তিনি সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নিলেও এতে সফল হতে পারেননি; কোম্পানির ভেতরের খবর ফাঁস হতে পারে- এমন আশঙ্কায় তাকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়। বোল্টসের এই উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ার প্রায় একযুগ পর ১৭৮০ সালের ২৯ জানুয়ারি শনিবার কলকাতা থেকে ভারতের প্রথম মুদ্রিত সংবাদপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘ক্যালকাটা জেনারেল অ্যাডভারটাইজার’। জেমস অগাস্টাস হিকি (১৭৪০-১৮০২) সম্পাদিত এ পত্রিকা অবশ্য লোকমুখে ‘হিকির গেজেট’ হিসেবেই বেশি পরিচিতি পায়।

পত্রিকাটি ছিলো ট্যাবলয়েড আকারের। পারিপাট্য, মুদ্রণের মান, বিষয়বস্তু বা নৈতিকতার বিচারে কোনো দিক থেকেই এটি ঠিক মানোত্তীর্ণ ছিলো না। তবে ইতিহাসবিদ ও সমালোচকদের বিচারে, তখন ভারতীয় সমাজে ইউরোপীয় সমাজের যে ছাপটি পড়েছিলো, তা ছিলো কদর্য, অশালীন ও কলুষ। পত্রিকাকে বলা হয় ‘সমাজের দর্পণ’; সেই বিচারে তখনকার সেই পঙ্কিল আর কদর্য সমাজেরই ছাপ পড়েছিলো হিকির গেজেটে। তাই এর ভাষা ও মান উন্নততর হওয়ার কোনো কারণ বা সুযোগ ছিলো না।

তবে হিকির গেজেট খুব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রোষানলে পড়ে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের তখনকার গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন হিকি। জনশ্রুতি ছিলো, ওই সময় গভর্নর জেনারেল পরিষদের অন্যতম সদস্য ফিলিপ ফ্রান্সিস ছিলেন হেস্টিংসের কট্টর সমালোচক এবং হিকির পরোক্ষ উৎসাহদাতা। ফ্রান্সিসের ব্যাপারে কখনোই নেতিবাচক কিছু না ছাপা হওয়ায় জনমনে এ ধারণা আরো দৃঢ় হয়। এদিকে সস্ত্রীক হেস্টিংস ও বিচারপতি এলিজা ইম্পে ছিলেন হিকির আক্রমণের মূল লক্ষ্য। আর সেই আক্রমণের ভাষা ক্রমেই কদর্যতর হতে থাকে। ফিলিপ ফ্রান্সিস যতোদিন ভারতবর্ষে ছিলেন, ততোদিন হিকির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। তবে তিনি ভারত ছাড়ার পর থেকে ক্রমেই হিকির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে শুরু করে কোম্পানি কর্তৃপক্ষ। পর্যায়ক্রমে ডাক বিভাগের সুবিধা বন্ধ করে দেয়া, কারাদণ্ড ও শেষে প্রেস বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে হেস্টিংস রীতিমতো পথে বসান হিকিকে। আর এভাবেই ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ হয়।

পত্রিকা ও নিজের জীবনের নির্মম পরিসমাপ্তির পর একটা দীর্ঘ সময় ইতিহাসে হিকি একজন কলঙ্কিত ব্যক্তির মতো বিবেচিত হয়েছেন। তবে সাম্প্রতিক গবেষকরা হিকিকে আবারো মর্যাদার আসনে বসানোর চেষ্টা করছেন। নতুন নতুন গবেষণায় পাওয়া তথ্যের বদৌলতে গবেষকরা হিকিকে একজন সত্যবাদী সাংবাদিক হিসেবে তুলে ধরছেন। হিকির গেজেট প্রথম প্রকাশের তারিখটিকে (২৯ জানুয়ারি) অনেক স্থানে ‌লড়াকু সাংবাদিকদের সম্মানে 'হিকিস ডে' হিসেবে পালন করা হয়।

নানাভাবে সৃষ্ট চাপের মুখে পড়ে শেষতক হিকি লিখেছিলেন, ‘যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়, একজন সাহসী মানুষ আর একটা স্বাধীন সংবাদপত্র তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না।’

কিন্তু কোনোভাবেই তিনি হেস্টিংসের মন গলাতে পারেননি।

তথ্যসূত্র :

Wolseley, Roland E.: Journalism in Modern India.

Mehta, D. S.: Mass Communication and Journalism in India.

ধর, সুব্রত শংকর (১৯৮৬) : বাংলাদেশের সংবাদপত্র

পাল, তারাপদ : ভারতের সংবাদপত্র