Media School

Dhaka    Friday, 26 April 2024

By উইলিয়াম নকরেক

‘হে তরুণ, তোমরাই জগতের লবণ ও আলো...’

Media School October 24, 2020

আমি তরুণদের সঙ্গে প্রায় ১০ বছর যাবৎ কাজ করছি। আমি নিজেও একজন তরুণ। ছোট্ট প্রত্যন্ত একটি গ্রাম থেকে উঠে এসে, আজ আমি এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তরুণদের সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছি। আমি বরাবরই তরুণদের সঙ্গে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, 'তরুণরাই পরিবর্তনের প্রতিনিধি'।

তরুণরা চাইলে ভাঙতেও পারে, আবার গড়তেও পারে। তাই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, "ওরে সবুজ, ওরে অবুঝ, আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।"

বাইবেলে যীশুখ্রিস্ট বলেছেন, "তোমরা পৃথিবীর লবণ ও আলো"। যীশু বলেন, "তোমরা পৃথিবীর লবণ, কিন্তু লবণের স্বাদ যদি যায়, তবে তা কীভাবে লবণের গুণবিশিষ্ট করা যাবে? তা আর কোনো কাজে লাগে না, কেবল বাইরে ফেলে দেবার ও লোকের পায়ের তলায় দলিত হবার যোগ্য হয়। তোমরা জগতের আলো; পর্বতের ওপরে অবস্থিত শহর গোপন থাকতে পারে না" (মথি ৫ঃ১৩-১৪)।

আমরা সবাই লবণের গুণ সম্পর্কে অবহিত। আমাদের জীবনে লবণের ব্যবহার ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। জীবদেহের স্বাভাবিক পুষ্টি ও বৃদ্ধি এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অর্জনের জন্য লবণের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও খাবারের বা তরকারির স্বাদের ক্ষেত্রে যেমন লবণের গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি খাবার সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও লবণের গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন : নোনা ইলিশ অনেকেরই অনেক পছন্দের। নোনা ইলিশ বা শুঁটকি বা মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও লবণের গুরুত্ব অনেক। অর্থাৎ খাবার নষ্ট হওয়া থেকে রক্ষা করে লবণ।

বাইবেলের আদিপুস্তকে বর্ণিত হয়েছে, সৃষ্টির শুরুতেই ঈশ্বর আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করলেন। এরপরই তিনি আলো সৃষ্টি করলেন। তিনি বললেন, 'আলো হোক' (আদিপুস্তক১ঃ১-৩)।

আলোর গুরুত্ব আমরা সবাই জানি। রবিঠাকুর লিখেছেন "আলো আমার আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা/আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা।" একটিগবেষণায় দেখা গেছে, শরীর, মন আর ঘুম ঠিক রাখতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় দিনের আলোতে থাকা উচিৎ। এতে শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক থাকে। পর্যাপ্ত সূর্যের আলোর অভাবে ইউরোপের ২-৮ শতাংশ মানুষ এক ধরনের ডিপ্রেশনে ভোগে যার নাম সিজনাল ইফেক্টিভ ডিসঅর্ডার। আলো আমাদের মস্তিষ্কে এমনকিছু পরিবর্তন আনে যা আমাদের শরীর, মন-মেজাজ ভালো রাখে। এছাড়াও আমাদের খাদ্য উৎপাদনে আলোর গুরুত্ব অপরিসীম।

তাইতো যীশু এই তরুণসমাজকে আলো ও লবণের সঙ্গে তুলনা করেছেন- যাদেরকে ছাড়া এই জগৎ আলো ও লবণবিহীন। স্বাদ ও আলোহীন একটি সমাজ অন্ধকারাচ্ছন্ন। যেখানে শুধু বিস্বাদ আর অন্ধকার। এই তরুণসমাজকে তিনি জেগে উঠতে বলছেন এবং মানুষের কল্যাণে কাজ করতে বলছেন। তাইতো তিনি বলছেন, "যুবক, আমি তোমায় বলছি তুমি ওঠো" (লুক ৭ঃ১৪)।

করোনার এই চ্যালেঞ্জের সময়ও তরুণরাই সবার আগে এগিয়ে এসেছে। সমাজ, দেশ ও বিশ্বের যেকোন ক্রান্তিলগ্নেই তরুণরা সবার আগে এগিয়ে এসেছে। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও এই তরুণরাই এগিয়ে আসবে। কাথলিক খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, "তরুণরা শুধু ভবিষ্যতের জন্যে নয়, তারাই বর্তমান"। অর্থাৎ এই তরুণরাই বর্তমান ও আগামীর নেতৃত্ব দেবে।  এজন্যেই যীশুখ্রিস্ট তরুণদের বলছেন, "তোমরাই জগতের আলো ও লবণ।" তারপরও দেশের সাম্প্রতিক কিছু নেতিবাচক সংবাদ মনকে অন্যরকম ভাবতে বাধ্য করে। কিন্তু আমি তেমন নেতিবাচক কিছু ভাবতে চাই না। কেননা এই তরুণরাই আবার অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে, আমাদেরকে আশাবাদী করে তুলছে, সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করি, পরিবর্তন আসবেই, আসতেই হবে।
 
তরুণদের মধ্যে আমি যীশুখ্রিস্টের ছায়া দেখতে পাই, যিনি নিজেও একজন তরুণ ছিলেন। মাত্র তিনটি বছর কাজ করে তিনি সমাজে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। পোপ ফ্রান্সিস বলেছেন, "প্রকৃত বিশ্বাস- কখনোই সম্পূর্ণরূপে সুখকর কিংবা ব্যক্তিগত নয়। বরং এতে যুক্ত থাকে পৃথিবীকেপরিবর্তন করার, অন্যের মধ্যে মূল্যবোধ সঞ্চার করার ও পৃথিবীকে আগের অবস্থা থেকে উন্নততর অবস্থায় পৌঁছে দেয়ার এক গভীর ইচ্ছা।" সেই কাজটিই যীশু করে গিয়েছিলেন। তাই যেন বর্তমান সময়েও যীশু আমাদের উদ্দেশে বলছেন, "দেহের মধ্যে প্রাণ যখন থাকে না, তখন সেই দেহ যেমন মৃত, তেমনি কর্মবিহীন বিশ্বাসও মৃত" (যাকোবের পত্র ২:২৬)। কথায় আছে, মানুষ তার কর্মেই আজীবন বেঁচে থাকে। আর আমরা যারা যীশুকে বিশ্বাস করি, তার বলে দেওয়া রাস্তায় হাঁটছি না। মানুষকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি না। তাদের ন্যায্যতার জন্যে কাজ করছি না। বরং উল্টো তাদের ন্যায্যতা থেকে বঞ্চিত করছি। আমাদের লোভ,
স্বার্থপরতা ও নিষ্ঠুরতা দেখে তিনি আমাদের বলছেন, 'তোমরা কেন আমাকে 'প্রভু, প্রভু বলে ডাক, অথচ আমি যা বলি তা কর না?" (লুক ৬:৪৬)।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন বা এসডিজির স্লোগান 'লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড' বা 'কাউকে পেছনে ফেলে রাখা নয়' খুব জনপ্রিয় হয়েছে। আমাদের দেশের সরকারের পাশাপাশি আমি আমাদের দেশের তরুণদের বলবো এই বিষয়ে সতর্ক থাকার জন্যে। কেননা বর্তমান ও আগামীর বিশ্ব, সমাজ ও দেশটিকে আমরাই নেতৃত্ব দেবো। আমাদের সবাইকে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কাউকে পেছনে ফেলে রাখা যাবে না। অর্থাৎ উন্নয়ন হতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক। এই দেশের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আদিবাসী, কৃষক, দিনমজুর, চা শ্রমিক, হরিজনসহ পাহাড় ও সমতলের মানুষ যেন বঞ্চিত না হয়। আমরা সবাইকে নিয়েই সামনে এগিয়ে যেতে চাই।

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য মাত্র একুশ বছর বেঁচেছিলেন। তিনি তার 'ছাড়পত্র' কবিতায় লিখেছেন, "এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;/জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।/চলে যেতে হবে আমাদের।/চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি-/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।।"

আমরা তরুণরা যেন আমাদের সমাজের, দেশের ও বিশ্বের যেকোন ক্রান্তিলগ্নে সবার আগে জেগে উঠতে পারি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের মত যেন বলে উঠতে পারি, "আমি হব সকাল বেলার পাখি/সবার আগে কুসুম-বাগে উঠব আমি ডাকি"। তরুণদের জাগাতে হবে, জেগে উঠতে হবে। তাই কবি নজরুল বলেছেন, "আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে?"
আমরা যেন ভূপেন হাজারিকার মত গেয়ে উঠতে পারি, "শিশিরে ভেজানো রাতে/বস্ত্রবিহীন কোনও খেতমজুরের/ভেঙে পড়া কুটিরের ধিকি ধিকি/জ্বলে থাকা, তুষে ঢাকা আগুনের/রক্তিম যেন এক উত্তাপ হই/সংখ্যালঘু কোনো সম্প্রদায়ের/ভয়ার্ত মানুষের না ফোটা আর্তনাদ যখন গুমরে কাঁদে/আমি যেন তার নিরাপত্তা হই"।

লেখক : উইলিয়াম নকরেক, এশিয়া প্যাসিফিক কোঅর্ডিনেটর, ইন্টারন্যাশনাল মুভমেন্ট অব কাথলিক স্টুডেন্টস-পাক্স রোমানা